ফুটপাত থেকে নামিদামি রেস্তোরাঁ- কোথাও নিশ্চিত হচ্ছে না নিরাপদ খাদ্য। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে মানহীন খাবার। খাবারে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রঙ ও রাসায়নিক। বাদ যাচ্ছে না নিষ্পাপ শিশুর খাদ্যও; মেশানো হচ্ছে ভেজাল। ঘটছে অপমৃত্যু, বাড়ছে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা। চারদিকে অনিরাপদ খাদ্যে সয়লাব হয়ে গেলেও তা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নেই। দিনের পর দিন প্রকাশ্যে এমন অনিয়ম চললেও সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো যেন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। অভিযান, অর্থদ্বণ্ডের মতো কিছু কার্যক্রম থাকলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তাই নামিদামি রেস্তোরাঁতেও খেতে বসে খাবারের মান নিয়ে সংশয়ে ভুগতে হচ্ছে ভোক্তাদের।মানসম্পন্ন খাবার নিশ্চিতে খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহন, সংরক্ষণ, পরিবেশন এবং গ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি পদেই রয়েছে গলদ। এদিকে দেশে খাদ্যের মান নিয়ে নানা উদ্বেগের মধ্যেই আজ রবিবার সারাদেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- খাদ্য হোক নিরাপদ, সুস্থ থাকুক জনগণ ।চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরার একটি বেকারিতে অভিযান পরিচালনা করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির অভিযানের চিত্র বলছে বেকারিটিতে নোংরা পরিবেশেই তৈরি হচ্ছিল কেক, রুটি, বিস্কুট ও চানাচুর। যেগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছিল ফুড গ্রেডবিহীন রঙ ও মাখন। বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করা কেকে ছিল না উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ। প্রতিষ্ঠানটিতে মজুদ করা খাদ্যপণ্যের কোনোটিরই বিএসটিআই সনদ ছিল না।
ভেজাল খাদ্য উৎপাদনে সারাদেশের চিত্রই এমন। খাদ্যপণ্য, ভোজ্যতেল, শিশুখাদ্য, বেকারি পণ্য, খাবার পানি থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ সব কিছুই নকল হচ্ছে। কিটক্যাট, লাভ ক্যান্ডি, রোলানা, সাফারি, ফাইভ স্টার, ক্যাডবেরিসহ বিশ্বখ্যাত নানা ব্র্যান্ডের চকোলেট তৈরি হচ্ছে কেরানীগঞ্জের জিনজিরার টিনশেডঘরে। ক্ষতিকর এসব নকল চকোলেট ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সারাদেশে। আটায় মেশানো হচ্ছে চকপাউডার। মিষ্টিজাতীয় খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত রঙ, সোডা, স্যাকারিন ও মোম। কাপড়ের বিষাক্ত রঙ, ইট ও কাঠের গুঁড়া মেশানো হচ্ছে মসলায়। ফলমূল দ্রুত পাকাতে কার্বাইড, ইথোফেন আর পচন রোধে ফরমালিন প্রয়োগ করা হচ্ছে।বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি মাসে তারা ৩২টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে। এতে অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের দায়ে ৩২ লাখ টাকা জরিমানাও আদায় করেছে তারা। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে সারাদেশে মোট ১১ হাজার ৩৬৬টি খাদ্য স্থাপনা পরিদর্শন করেছে তারা। এর মধ্যে আইনের ব্যত্যয় হওয়ায় ২০৩টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে সংস্থাটি। এতে নিরাপদ খাদ্য আইন না মেনে ব্যবসা পরিচালনা করা ২২৬ ব্যক্তি থেকে ২ কোটি ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ২০২৩ সালে এই জরিমানা আদায়ের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে অভিযান আর অর্থদ্বণ্ডেও থামানো যাচ্ছে না অনিরাপদ খাদ্যের উৎপাদন বিপণন।
প্রয়োজনের তুলনায় অভিযানের সংখ্যা যৎসামান্য। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকেও দুষছেন তারা। এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, কর্তৃপক্ষ আসলে তার স্বার্থরক্ষা করবে আগে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে তারা মূলত ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষা করে। তিনি আরও বলেন, যে পরিমাণ অভিযান হওয়া প্রয়োজন সেই পরিমাণে হচ্ছে না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে ফলোআপের জন্য বলেছি, যা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। একবার অভিযান পরিচালনা করে পরবর্তী তদারকি না থাকায় ওই ব্যবসায়ী আবারও একই অপরাধ করছে। এখানে একটা ডাটাবেইজ থাকা দরকার যে, কাদেরকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, কোন অপরাধে দেওয়া হচ্ছে এবং পরবর্তী সময়ে ওই ব্যবসায়ী একই অপরাধ করছে কিনা।