সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন- এ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও দেশবাসী এখন ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কার বা নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। এদিকে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রূপরেখা চাইছে। তারা বলছেন, একমাত্র রাজনৈতিক সরকারের পক্ষেই দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। নির্বাচন না হলে দেশের সংকট-অনিশ্চয়তা কাটবে না। সংস্কারের ব্যাপারে কারও কোনো আপত্তি নেই। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া। তবে সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন হতে পারে বলে আভাস দিচ্ছেন। আবার অনেকে বলছেন, সংস্কার শেষে নির্বাচন। এ অবস্থায় জনমনে প্রশ্ন উঠছে আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন। নির্বাচন কবে হবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা না এলেও বিষয়টি এখন সব মহলে আলোচিত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এর মধ্যে সরকারের মেয়াদ চার মাস পেরিয়ে গেছে। সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছে। নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান, দুর্নীতি দমনসহ ১০টি বিষয়ে সংস্কারের জন্য সরকার কমিশন গঠন করেছে। বেশির ভাগ কমিশন ডিসেম্বর ৩১ নাগাদ সুপারিশমালা করবে। আর সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে সরকার। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে বলা হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, নির্বাচিত সরকার ছাড়া জনগণের প্রত্যাশা আর কেউ পূরণ করতে পারবে না। সেজন্য প্রথমত, প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। পরে সেই সংস্কার অনুমোদন করা হবে। তাই নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, রাষ্ট্রীয় সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন যেন প্রলম্বিত না হয়, সেটা মাথায় রেখে সরকারকে একটি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে যে সংস্কার কার্যক্রম করা দরকার, তা করতে হবে। তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব সংস্কারগুলো শেষ করে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।এদিকে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী শুরুতে নির্বাচনের তাগিদ না দিলেও সভা-সমাবেশে দলের পক্ষ থেকে দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, প্রত্যাশার মূল কেন্দ্রবিন্দু আগামী জাতীয় নির্বাচন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রয়োজনীয় নির্বাচনি সংস্কার। সংস্কারের লক্ষ্যে যে কমিশন গঠিত হয়েছে, তার গতি বাড়াতে হবে। সংস্কারের ব্যাপকভিত্তিক কাজ হাতে নিয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ যেমন- নির্বাচন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সুশাসন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে চলে যাওয়া উচিত। যেন জনগণের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে আসে। দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা ফিরলে জনমনে স্বস্তি ফিরবে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিনের আধিপত্যবাদী শাসন শেষে জমে থাকা জঞ্জাল পরিষ্কার করে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে তা কেউ ভাবে না। কিন্তু অনির্দিষ্ট সময় লক্ষ্যহীন যাত্রায় দেশ চলুক সেটিও কাক্সিক্ষত নয়। বৈষম্যহীন ছাত্র-জনতা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে আত্মাহুতি দিয়েছে তার মূলে রয়েছে পরিবর্তিত সামাজিক ব্যবস্থা। তাই জঞ্জাল যতটা সম্ভব শেষ করেই নির্বাচন দিতে হবে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক বলেন, জুলাই-আগস্টের বিপ্লব শুধু শাসকের চেহারা বদল করার জন্য হয়নি। শাসকদের গুণগত মান পরিবর্তন করে বৈষম্যহীন একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই বিপ্লব হয়েছে। জুলাই বিপ্লবসহ বিগত ১৬ বছরে বাংলাদেশে সংঘটিত প্রতিটি হত্যা, গুম, খুন ও জুলুমের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দেশে কোনো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে না। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, আগে রাষ্ট্র সংস্কার ও জন-আকাঙ্খা পূর্ণ করতে হবে, পরে নির্বাচনের কথা ভাবতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, দেশে নতুন গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক করে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কার ও রূপান্তর ঘটাতে হবে। যাতে জনগণ, রাষ্ট্র, সমাজ সব ক্ষেত্রে গণক্ষমতায়ন হয়, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হয়। সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সব সংস্কার কমিশন রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় কোন কোন খাতে কী কী সংস্কার করা হবে, তা ঠিক করা হবে। সংস্কারের জন্য কত সময় লাগবে, সেই সময়সীমারও ধারণা পাওয়া যাবে। তখনই আসলে নির্বাচন কবে সম্ভব এর একটা প্রকৃত সময় জানা যাবে। তারা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সংস্কারের কথা বলা হলেও গণতান্ত্রিক দলগুলো বরাবরই বলছে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। নির্বাচন ইস্যুতে সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপির দাবি অমূলক নয়, তবে জনগণ আগে সংস্কার চায়। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল বা যে কেউ নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে পারে। তবে নির্বাচন এবং সংস্কার দুটো নিয়েই কাজ করছে সরকার। এদিকে গতকাল রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে প্রশ্ন তুলে বলেন, রাজনীতিবিদরাই যদি সংস্কার করেন, তাহলে গত ৫৩ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি কেন? রাজনৈতিক সংস্কারে অগ্রগতির অভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে কয়েক দশকের স্থবিরতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহি নেওয়ার আহ্বান জানান রিজওয়ানা হাসান।