জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৮৫৮ জন নিহত এবং সাড়ে ১১ হাজার জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীই বেশি। গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল প্রথম ধাপে গতকাল শনিবার আন্দোলনে হতাহতদের একটি খসড়া তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি দেশের মানুষের কাছে মতামতও চেয়েছে। বিশেষ সেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব খন্দকার জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, খসড়া তালিকা দুটি খসড়া চূড়ান্ত করতে ২৩ ডিসেম্বর (আগামীকাল) পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।মিরপুর আব্বাস উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র মাহফুজুর রহমান (১৬) গত ১৯ জুলাই মিরপুর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মিছিলে নেমে গুলিবিদ্ধ হয়। ২০ জুলাই শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাওয়া যায় তার লাশ। ওই দিনই তাকে বাগেরহাটের গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মাহফুজ ছিলেন আব্দুল মান্নানের একমাত্র সন্তান।সরকারিভাবে শহীদদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে মাহফুজুর রহমানের নাম এক নম্বরে। গতকাল সন্ধ্যায় কথা হয় শহীদ মাহফুজুরের চাচা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের সন্তানকে সরাসরি গুলি করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে পুলিশ। এখন তো সন্তানকে আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। টাকা-পয়সা দিলেও সন্তান আর ফিরে আসবে না। এখন আমাদের চাওয়া, ওর মূল্যায়ন এবং হত্যার সুষ্ঠু বিচার। এটা নিয়ে রাজনীতিও করতে চাই না। তিনি খোদের সঙ্গে বলেন, হত্যার পর চার-পাঁচ মাসও যায়নি, এখনই অনেক তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হচ্ছে।
নিহতের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ৮৫৮ জন নিহত হয়েছেন। তাদের একটি বড় অংশেরই পেশার উল্লেখ নেই। নিহতের মধ্যে ২০০ জনকে শিক্ষার্থী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই হিসাবে নিহতের ২৩ শতাংশই শিক্ষার্থী।সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শহীদের তালিকায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক থেকে শুরু করে কাঠমিস্ত্রিও রয়েছেন। এতে প্রমাণ হয়, সব শ্রেণিপেশার মানুষ এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। একটি বড় অংশ শহীদ হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। দ্বীপ জেলা ভোলারও ৪৪ জন এ গণ-অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। অর্থাৎ দেশের সর্বত্রই এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল।কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাইয়ের শেষ দিকে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার তুমুল এ আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যান। এর আগে এ আন্দোলন দমাতে গিয়ে সরকার যারপরনাই সহিংস হয়ে ওঠে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহত হয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে হতাহতের এ তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। পরে জুলাই-আগস্টে হতাহতদের তালিকা তৈরি করতে ১৫ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটি গত ২৯ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৭১৭ জনের নিহতের তালিকা প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস)।তখন গণবিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলেছিল, সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শহীদদের মধ্যে যদি কারও নাম এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকে তাহলে শহীদ পরিবারের সদস্য, ওয়ারিশ, প্রতিনিধিদের উপযুক্ত প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
তবে ২৮ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটি আন্দোলনে নিহত ও আহতদের সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করে। সেদিন বলা হয়, আন্দোলনে ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত হয়েছেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের অডিটোরিয়ামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটি, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সেদিন বলা হয় আন্দোলনকালে ৩১ হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন। তবে এটি আরও যাচাই-বাছাই করা হবে।সবশেষ গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল গতকাল বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, শহীদ বা আহত হয়েছেন- এমন ব্যক্তিদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ৬৪টি জেলায় গঠিত জেলা কমিটি এবং গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল কাজ করছে। প্রকাশিত খসড়া তালিকা দুটিতে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য যাচাই, সংশোধন ও চূড়ান্ত করতে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য, ওয়ারিশ, প্রতিনিধিদের মতামতের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।