চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস মিলছে না শিল্প-কারখানায়। বেশ কিছুদিন ধরে চলা এ সংকটে কমে গেছে শিল্প-কারখানার উৎপাদন। সিরামিক, ইস্পাত ও টেক্সটাইল খাতের উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাস সংকটে শিল্প খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। গত কয়েক মাসে কয়েক শ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। রপ্তানি আয় কমেছে। বিনিয়োগ থমকে আছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে না। শিল্প খাত না বাঁচলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। তাই শিল্পের গ্যাস-বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কমার পাশাপাশি রপ্তানি আয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে ডলার সংকট তীব্র হবে।উৎপাদন কমে যাওয়ায় শিল্পের কাঁচামালের আমদানিও কমেছে ৯.৮১ শতাংশ। শিল্প-কারখানার যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ৪১ শতাংশ কমেছে।সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় শিল্প-কারখানা, সিএনজি স্টেশন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, আবাসিক খাতসহ সব ক্ষেত্রে এখন সংকট চলছে।গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও সাভার এলাকার শিল্প-কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় এসব এলাকার শিল্প-কারখানা কখনো চলছে, কখনো বন্ধ থাকছে।গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা থাকলেও গ্যাসের সংকটে শিল্প-কারখানাগুলো সেগুলোও চালাতে পারছে না। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে শিল্পোদ্যোক্তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি ও মুন্নু সিরামিকস ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চলা গ্যাস সংকটে সিরামিক খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এরই মধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে গ্যাসের স্বল্প চাপের কারণে গাজীপুর ও নরসিংদী অঞ্চলের কারখানাগুলোর ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। তবে গ্যাসের চরম সংকট সাভার ও ধামরাই অঞ্চলের কারখানাগুলোতে। এসব এলাকার সিরামিক কারখানার উৎপাদন প্রায় ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। যেহেতু দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না, এর পরও সরকার এলএনজি আমদানি বাড়াচ্ছে না। এতে বোঝা যাচ্ছে, এই গ্যাস সংকট দীর্ঘমেয়াদি হবে।বিসিএমইএ সভাপতি বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে এর মধ্যে অনেক কারখানা গ্যাসের বিকল্প হিসেবে ব্যয়বহুল তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) এবং কয়লা ব্যবহার করছে। এতে তাদের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। তবে পর্যাপ্ত গ্যাসের সরবরাহ থাকায় হবিগঞ্জ ও ভোলা অঞ্চলে যেসব কারখানা রয়েছে, সেগুলো পুরো সক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে।দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ডিভিশন) প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, আমাদের বিতরণ এলাকায় বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ২৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে আমরা সরবরাহ দিতে পারছি মাত্র দৈনিক ১৫৫০ থেকে ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। চাহিদার তুলনায় সরবরাহের বড় ঘাটতির কারণে গ্যাস সংকট দেখা দিচ্ছে।তিনি বলেন, আমাদের এই ঘাটতির কথা প্রায়ই মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার বৈঠকে ওঠানো হয়। এর পরও সমাধান নেই।
সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে প্রায় দেড় হাজারের মতো ছোট-বড় শিল্প-কারখানা। এসব কারখানার জেনারেটর বা বয়লার চালাতে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট) চাপের গ্যাস প্রয়োজন, কিন্তু বর্তমানে তা অর্ধেকের নিচে। কারখানা মালিকরা বলছেন, এই চাপ সংকটের কারণে বিকল্প জ্বালানিতে চলছে কারখানাগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম। এতে তাঁদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে অনেক।সাভারের পাকিজা গ্রুপের অ্যাডমিন ম্যানেজার মো. মোস্তাকিম বলেন, আমাদের কারখানায় গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে বিকল্প হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে উৎপাদন চালু রাখা গেলেও তা ব্যয়বহুল।বিভিন্ন শিল্প-কারখানার কর্মকর্তাদের অভিযোগ, গ্যাস সংকটে সাভার-আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কারখানাগুলোতে আগে ঘণ্টায় যে উৎপাদন হতো, এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে সময়মতো পণ্য শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাভারের আল মুসলিম গ্রুপের একজন কর্মকর্তা বলেন, চাপ কম থাকায় আমাদের কারখানায় বারবার গ্যাস সংকট দেখা দিচ্ছে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার বাজারে আমাদের কারখানায় উৎপাদন চালিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হয়। লাইনে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকায় বাধ্য হয়ে বিকল্প জ্বালানির মাধ্যমে উৎপাদন চালিয়ে নিতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে চার হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গতকাল শনিবার সর্বোচ্চ দুই হাজার ৭৪১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এতে গতকাল ঘাটতি ছিল এক হাজার ৪৫৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। মোট দুই হাজার ৭৪১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এক হাজার ৮৮৯ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানিকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে ৮৫১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত দেশের শিল্প খাতে জ্বালানি সংকট সমাধানের পথ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, জ্বালানি সংকটে সিরামিক কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। পোশাক খাতে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। স্টিল কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। গ্যাসের বিকল্প হিসেবে ডিজেল ব্যবহার ও শ্রমিকদের বাড়তি কাজের জন্য খরচ বেড়ে গেছে। পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন ক্ষুদ্র শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের ডিজেল জেনারেটর চালানো সম্ভব নয়। ফলে প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধের পথে। শিল্পখাতে গ্যাসের চাহিদা ১০০ কোটি ঘনফুটের মতো। কিন্তু এখন দেওয়া হচ্ছে ৫০ কোটি ঘনফুট। গত দুই বছরে শিল্প খাতে জ্বালানির চাহিদা বাড়েনি।