
হাসিনা সরকারের পতনের ছয় মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। বদলি, পদোন্নতিতে বারবার সিদ্ধান্ত বদল করতে হচ্ছে। কিছু পদে কাক্সিক্ষত ব্যক্তি মিলছে না। ফলে গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য দীর্ঘদিন ধরে। বৈষম্য নিরসনে অবসরে যাওয়ার ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়েছেন কেউ কেউ। এটিকে উল্টো বৈষম্য হিসেবে চিহ্নিত করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। সরকারি চাকরিজীবীদের মহার্ঘ ভাতা নিয়ে বিতর্কের মুখে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে হয়েছে। একই সঙ্গে মাঠ প্রশাসনেও চলছে অস্বস্তি। এ অবস্থায় আগামী রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে জেলা প্রশাসক সম্মেলন। এবার এতে বিশেষ গুরুত্ব পাবে নির্বাচন প্রসঙ্গ। ১৬-১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ডিসি সম্মেলনে এবার প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করবেন জেলা প্রশাসকরা।আন্দোলনে কাজে ব্যাঘাত, নিরাপত্তা ঝুঁকি : নানা সংকটের মধ্য দিয়ে চলা জনপ্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের সামনে প্রতিদিনই নানা দাবিতে চলছে আন্দোলন। কেপিআইভুক্ত এলাকায় এভাবে মিছিল-মিটিংয়ের জেরে গেট বন্ধ রাখতে হচ্ছে সচিবালয়ের। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে একজন উপদেষ্টার গাড়িও সচিবালয়ের (বিদ্যুৎ ভবনসংলগ্ন) গেট দিয়ে ঢুকতে বেগ পেতে হয় এ আন্দোলনের কারণে। আন্দোলনের জেরে প্রায় প্রতি কর্মদিবসেই সচিবালয়ে সব কটি গেট বন্ধ রাখতে বাধ্য হন সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের কাজে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। কেপিআইভুক্ত এলাকায় নানা কর্মসূচির সুযোগ নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
নরসিংদী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীরা গতকাল সচিবালয়ের সামনে আন্দোলন শুরু করলে প্রশাসনিক কাজে ব্যাঘাত ঘটে। সচিবালয়ের প্রধান গেটে অবস্থান এবং ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ নিয়ে লাঠিচার্জের ঘটনাও ঘটে। অথচ কেপিআই নিরাপত্তা নীতিমালা অনুযায়ী ওই এলাকায় এ ধরনের কর্মকা-ের কোনো সুযোগ নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে এ ধরনের কর্মসূচি পালনে সচিবালয় এলাকায় যাওয়ার আগেই তা ঠেকানো জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে।জনপ্রশাসনে সমন্বয়হীনতা, অসন্তুষ্টি : সংশ্লিষ্টরা জানান, জনপ্রশাসনে দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনের প্রবণতা দূর হয়নি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনে বিষয়টির গুরুত্ব পেয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, আগে একটি দলের পরিচয়ে প্রভাব চলত। এখন পরিচয় পাল্টে একই কায়দায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলছে। একজন উপসচিব তার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা যুগ্ম সচিবের রুমে গিয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন- এমন খবরও মিলছে। যদিও পরবর্তী সময় তাকে সচিবালয়ের বাইরে বদলি করা হয়েছে। আবার ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বহালতবিয়তে থাকা নিয়েও প্রশ্ন আছে, অনেকের মধ্যে অসন্তুষ্টি বিরাজ করছে। একই ব্যক্তিদের দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ায় আগের সরকারের অনিয়ম বা দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ গোপন করার চেষ্টা হয়েছে কিনা সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। আবার এটাও ঠিক, বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদে দায়িত্ব দিতে হিমশিম খেয়েছে। বদলি-পদোন্নতিতে সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়েছে এ কারণে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমন্বয়হীনতার কারণে সচিব, জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েও তা বাতিল করতে হয়েছে। বদলি-পদায়নে পরামর্শ দিতে অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠন করতে হয়েছে উপদেষ্টা কমিটি। ডিসির ফিটলিস্ট তৈরির কাজও স্থগিত। অন্তত ৯ মন্ত্রণালয়ে সচিবের পদ ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালাতে হচ্ছে। সেতু বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, সংসদ সচিবালয়ের মতো জায়গায় সচিব নেই অনেক দিন ধরে। ফলে চলতি দায়িত্বে কাজ চলছে। এসব স্থানে কাকে সচিব বানানো হবে- এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা রয়েছে। এ ছাড়া ঝুলে আছে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের পদোন্নতি। এসব বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আমলাদের একটি বড় অংশ বর্তমান সরকারকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করতে চাইছে না। এ জন্য নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে ভুল সিদ্ধান্তের জের সরকারকে টানতে হচ্ছে। একাধিক কর্মকর্তা জানান, আগামীতে কোন সরকার ক্ষমতায় আসবে তা বিবেচনায় নিয়ে পথ চলতে চান কেউ কেউ, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রশাসনের কাজে।গত তিন নির্বাচনে পুলিশ ও মাঠ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়। চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। রিটার্নিং অফিসার হিসেবে জেলা প্রশাসক (ডিসি), সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) দায়িত্ব পালন করেন। এদের নির্দেশনায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন বিভাগীয় কমিশনাররা। প্রশাসনের কর্মকর্তারা দলীয় কর্মীর মতো এমন আচরণ করার কারণ হিসেবে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রভাব থাকে বদলি ও পদোন্নতিতে। তাই তারা মুখাপেক্ষী।