‌‍ ‘সেনাবাহিনী পদক’পেলেন সেনাপ্রধানভারতকে হারিয়ে ফাইনালে বাংলাদেশব্যয়ের সামর্থ্যে অভিভাবকদের প্রথম পছন্দ সরকারি স্কুল৩ দিনের সফরে আজ ঢাকায় আসছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রস্থল হয়ে উঠছে ঢাকার চারপাশ
No icon

ব্যয়ের সামর্থ্যে অভিভাবকদের প্রথম পছন্দ সরকারি স্কুল

২০২৬ সালের শিক্ষাবর্ষে স্কুলে ভর্তির আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছে গতকাল শুক্রবার। ২১ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনলাইনে ভর্তির আবেদন চলবে। কেন্দ্রীয় ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে সারাদেশের ৬৮৬টি সরকারি স্কুল এবং ৩ হাজার ৩৫৯টি বেসরকারি স্কুলে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী নির্বাচিত হবে। আবেদন ফি নির্ধারিত হয়েছে ১০০ টাকা।প্রতিবছরের মতো এবারও ভর্তির মৌসুম শুরু হতেই আবার আলোচনায় এসেছে সরকারি বনাম বেসরকারি বিদ্যালয়ের অবস্থান, আসনসংকট এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষাব্যয়ের ভাবনা। বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে সরকারি স্কুলে আগ্রহ বেড়েছে বহুগুণ, যদিও মাধ্যমিক স্তরের ৯৩ শতাংশ বিদ্যালয়ই বেসরকারি। তবুও কেন সরকারি স্কুল? অভিভাবকদের উত্তর স্পষ্ট- ব্যয়ভার।বেসরকারি বিদ্যালয়ের টিউশন ফি, উন্নয়ন শুল্ক, বার্ষিক চার্জ এবং আনুষঙ্গিক খরচ এখন অনেক পরিবারের নাগালের বাইরে। ফলে সরকারি বিদ্যালয়ই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে।দ্বিতীয় শ্রেণিতে সন্তানের ভর্তির অপেক্ষায় থাকা ফৌজিয়া আক্তার সিনথিয়া বলেন, আমরা সব সময় সরকারি স্কুলেই আবেদন করি প্রথমে। নামি বেসরকারি স্কুলে মান ভালো- সেটা ঠিক; কিন্তু খরচ এত বেশি যে মধ্যবিত্ত পরিবার হিমশিম খায়।

রাজধানীর মিরপুরে আরেক অভিভাবক রকিবুল হোসেন জানান, আমার মেয়েকে একটি পরিচিত বেসরকারি স্কুলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভর্তি ফি, সেশন চার্জ, ইউনিফম- সব মিলিয়ে প্রথমেই ৫০-৬০ হাজার টাকার প্রস্তুতি নিতে হয়। এই বাস্তবতায় সরকারি স্কুল ছাড়া অন্য বিকল্প নেই।চট্টগ্রামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা নাসরিন শবনম বলেন, আমরা সন্তানকে ভালো স্কুলে দিতে চাই। কিন্তু ভালো বেসরকারি স্কুলগুলো এত ব্যয়বহুল যে অভিভাবকদের বড় অংশ মানসিক চাপে থাকেন। সরকারি স্কুলে ভর্তিই এখন বাস্তবসম্মত পথ। অন্যদিকে ঢাকার নামি একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তিচ্ছু এক শিক্ষার্থীর মা ফারজানা ইসলাম জুঁই বলেন, সন্তানের ইচ্ছা আছে; স্কুলের সুনামও আছে। কিন্তু খরচ এত বেশি যে ভবিষ্যতের পড়ালেখার ব্যয় নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তা।অভিভাবকদের এই উদ্বেগ শুধু টাকার হিসাব নয়- তারা বলছেন, বেসরকারি স্কুলে নিয়মের নামে বহু গোপন ব্যয় সামনে এসে দাঁড়ায়।

শিক্ষাবিদদের উদ্বেগ, বেসরকারি আধিক্যে শিক্ষাবৈষম্য বাড়ছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বেসরকারি স্কুলের আধিক্য সত্ত্বেও গুণগত সমতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক বেসরকারি বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক বা অবকাঠামো নেই। আবার কিছু বিদ্যালয় কাগজে-কলমে অনেক নামি হলেও শিক্ষায় মানসিক, ভাষিক বা সৃজনশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করা হয় না।এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, মাধ্যমিক স্তরে বেসরকারি স্কুলের আধিক্য শিক্ষাবৈষম্যকে বাড়িয়ে তোলে। শিক্ষায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।তিনি আরও বলেন, সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং মানসম্মত পাঠদান নিশ্চিত করা জরুরি। শুধু ভবন তৈরি করলেই গুণগত শিক্ষা হবে না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, শিক্ষার খরচ যেভাবে বাড়ছে, মধ্যবিত্ত পরিবারই সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ছে। সরকারি মাধ্যমিক স্কুলই পারে এই অসাম্য কমাতে। সরকারের উচিত দ্রুত বিস্তৃত পরিকল্পনা নেওয়া। একটা বড় অংশের পরিবার সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে দিতে চায়, কিন্তু অতিরিক্ত ব্যয় তাদের পিছিয়ে দেয়। সরকারি স্কুলের সংখ্যা বাড়লে এই চাপ কমে যাবে।সরকারের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, সরকারি স্কুল বাড়ানো সময়ের দাবি। আমরা নতুন স্কুল স্থাপন ও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিকায়ন নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।তিনি যোগ করেন, অভিভাবকদের চাহিদা ও দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় সরকারি মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে।ডিজিটাল লটারি, শ্রেণি-শাখা অনুযায়ী ভর্তির সীমা, বয়স যাচাই- সবই স্বচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার অংশ বলেও জানান কর্মকর্তারা।অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, সরকারি স্কুলের মান ও সংখ্যা বাড়াতে হবে। লটারিতে আসন না পাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে হাজারো পরিবার উদ্বিগ্ন থাকে। মধ্যবিত্ত পরিবারকে সাশ্রয়ী শিক্ষার সুযোগ দিতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো অপরিহার্য।

ভর্তির মৌসুম যত এগোচ্ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে- বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় চাপ এখন মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর। সরকারি স্কুল সীমিত, বেসরকারি ব্যয়বহুল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হচ্ছে চাপ, প্রতিযোগিতা এবং এক ধরনের অনিশ্চয়তা। শিক্ষাবিদ, অভিভাবক ও নীতিনির্ধারক- সবাই একটি জায়গায় একমত যে, সামাজিক বৈষম্য কমাতে এবং গুণগত শিক্ষা সবার কাছে পৌঁছে দিতে সরকারি মাধ্যমিক স্কুল বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।এ বছর লটারি কমিটির সদস্যসচিব এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক ইউনুস ফারুকী জানান, প্রথম থেকে নবম শ্রেণির ১১ লাখের বেশি আসন কেন্দ্রীয় লটারিতে যুক্ত করা হয়েছে। আবেদনকারীর চাপ সরকারি প্রতিষ্ঠানে এখনও সর্বাধিক। সরকারি স্কুলে প্রতি শ্রেণি-শাখায় সর্বোচ্চ ৫৫ শিক্ষার্থী নেওয়ার সীমাবদ্ধতা থাকায় এই চাপ আরও বাড়ছে।উল্লেখ্য, ভর্তিযোগ্য আসন সরকারি স্কুলে ১ লাখ ২০ হাজার ২৫৮; অন্যদিকে বেসরকারি স্কুলে ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮১১। মোট আসনের সিংহভাগই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তবুও আবেদন সবচেয়ে বেশি সরকারি স্কুলেই।