মূল্যস্ফীতির কষাঘাতে পিষ্ট সাধারণ মানুষ; সরকারও বিব্রত। টানা আট মাস ধরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে আছে। গত নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে উঠেছে। অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে খাদ্য কেনা গেছে, চলতি বছরের নভেম্বরে একই পরিমাণ খাদ্যপণ্য কিনতে প্রয়োজন হচ্ছে ১১৩ টাকা ৮০ পয়সা। এটি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো কাজ করছে না। এর মধ্যে আগস্টের পর দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে অনেক পণ্যের আমদানি বিঘ্নিত হওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে এর প্রভাব পড়ছে। এ থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এবং দীর্ঘদিনের এই নির্ভরতা কাটাতে নিত্যপণ্য আমদানিতে বিকল্প দেশের সন্ধান করছে সরকার। একক উৎস-দেশের ওপর নির্ভরতা কাটাতে বিকল্প দেশ খোঁজার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও (বিটিটিসি)। ইতোমধ্যে বিটিটিসি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। সেখানে ভারতের পাশাপাশি আরও কিছু দেশ চিহ্নিত করা হয়েছে।আলু-পেঁয়াজের দাম ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে বিকল্প উৎসের সন্ধান দিয়েছে বিটিটিসি। বিটিটিসির এ প্রস্তাবনার ধারাবাহিতকায় বিকল্প দেশ থেকে এসব পণ্য আমদানিতে আমদানিকারকদের মনোযোগী হওয়ার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও মনে করেন, যথাযথ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা থাকলে নিত্যপণ্যের চাহিদা পূরণে বিকল্প দেশ থেকে আমদানি করে দেশের সরবরাহ স্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রাখা সম্ভব। সঠিক পরিকল্পনা ও বাজার পর্যবেক্ষণ থাকলে খরচও কমিয়ে আনা যাবে।
জানা গেছে, বর্তমানে ভারত ও মিয়ানমার এ দুই দেশ থেকে পেঁয়াজ বেশি আমদানি হচ্ছে। পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে পাকিস্তান, চীন ও তুরস্ক থেকেও আমদানি হচ্ছে। আর আলু আমদানি হচ্ছে শুধু ভারত থেকে। এক্ষেত্রে আলু আমদানিতে জার্মান, মিশর, চীন ও স্পেনের কথা বলা হয়েছে বিটিটিসির প্রতিবেদনে। আর চীন, পাকিস্তান ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানির কথা বলা হয়েছে।বিটিটিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৯ লাখ টন। তবে ৩০ শতাংশ সংরক্ষণকালীন ক্ষতি ও বীজ বাদে সরবরাহ হয়েছে ২৭ লাখ টনের কিছু বেশি। যদিও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, উৎপাদন ও চাহিদার হিসাব ঠিক নেই। এ কারণে দেশে ভালো উৎপাদনের পরও চাহিদার অন্তত ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, মিশর, চীন ও মিয়ানমার থেকে সাড়ে ৯ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।আলুর বিষয়ে বলা হয়েছে, দেশে বছরে আলুর চাহিদা ৮৫ থেকে ৯০ লাখ টন। স্থানীয় উৎপাদন ১০৬ লাখ টন। ২৫ শতাংশ সংরক্ষণকালীন ক্ষতি ও বীজ বাদে সরবরাহ সাড়ে ৭৯ লাখ টন। ভারত থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আলু আমদানি হয়েছে দেড় লাখ টন।
বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেন, জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্টের বিষয়ে সরকার অবগত। দাম কমানোর ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ চেষ্টা বহাল আছে। এ পর্যন্ত নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ইতোমধ্যে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে ভোক্তাদের স্বস্তি আসতে শুরু করেছে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও পরিমাণ আরও বাড়ানো গেলে দ্রুত দ্রব্যমূল্যে স্থিতিশীলতা আসবে। তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে কিছু তাৎক্ষণিক ও কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দাম বেড়ে যাওয়ার পর আমরা টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে আলু বিক্রি শুরু করেছি। পাশাপাশি আলু আমদানির অনুমোদনও দেওয়া আছে। এসব তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সহযোগিতায় খেজুর, চিনি, সয়াবিন তেল, ডিমসহ আরও কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমানো হয়েছে। এতে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হবে, এটা মেনে নিয়েই শুধু পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা আনতে এসব শুল্ক কমানো হয়েছে।বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশকে উদার ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় বাজারে যে সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়, এখন দেশের ক্ষেত্রে (পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে) সিন্ডিকেট হলেও সমস্যা। অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক নয়। বাংলাদেশের জন্য ভারত, পাকিস্তান বা চীন কোনো ইস্যু নয়; বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবাইকে আমরা সংযুক্ত করতে চাই।
দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে পার্শবর্তী দেশ ভারত থেকে প্রতিবছর পেঁয়াজ, চাল, ডাল, কাঁচামরিচ, আদা ও মসলাসহ অনেক ধরনের নিত্যপণ্য আমদানি হয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দেশটির ওপর নির্ভরতা অনেকখানি বেড়েছে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য নির্দিষ্ট একটি বা দুটি দেশের ওপর নির্ভরতাও বেড়েছে। ফলে সেসব দেশে রপ্তানি কড়াকড়ি হলে কিংবা নিষেধাজ্ঞা দিলে দেশের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। তাই কোনো পণ্যের আমদানির জন্য কোনো একটি দেশের ওপর নির্ভর না করে বিকল্প উৎসের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।বর্তমানে পেঁয়াজ ও আলুর বাজার সামাল দিতে সরকার শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। এরপরও আমদানি বাড়ছে না। খরচ বেড়ে যাওয়া এবং পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতায় ভারত থেকে পণ্য আমদানি বিঘ্নিত হচ্ছে। অপরদিকে বিকল্প উৎস দেশগুলো থেকে স্বল্প পরিমাণে আমদানি হওয়ায় দেশের বাজারে সরবরাহ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে বাড়ছে না। ফলে বাজারে স্বস্তি ফেরাতে সরকারকে বেগ পেতে হচ্ছে। এর মধ্যে আসন্ন রমজানে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। তাই ভারতের পাশাপাশি অন্যান্য দেশ থেকে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে।