ঢাকাসহ সারাদেশে ছয় বছরে খুন হয়েছে ১৯ হাজার ৪০ জন। সে হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে নিহত হয় ২৮০ জন। তবে গত জুলাই-আগস্টে ঢাকাসহ সারাদেশে খুনের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি, ৯৫২ জন।বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটের ক্রাইম (অপরাধ) থেকে এ তথ্য মিলেছে। ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে খুন হয়েছে এক হাজার ৫৩৩ জন। সে হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে ২৫৫ জন মারা গেছে। পারিবারিক, সন্ত্রাসী বা দুর্বৃত্তের হাতে এসব খুনের ঘটনা ঘটে।তবে গত জুলাই ও আগস্টে নিহতের সংখ্যা ৯৫২, গড়ে ৪৭৬ জন। আন্দোলন ছাড়াও পারিবারিক, সন্ত্রাসী বা দু্র্বৃত্তদের হাতে খুনের ঘটনা আছে এই তালিকায়। অবশ্য জুলাই-আগস্টে গণআন্দোলনের সময় মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে তা বিভিন্ন সংগঠনের তথ্যে উঠে এসেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির তথ্যানুযায়ী, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জুলাই-আগস্টে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ৫৮১ জন। অবশ্য পুলিশ জুলাই আগস্টে যে তালিকা করেছে, সেটি শুধু মামলার ভিত্তিতে। আগস্টের পরও আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় মামলা অব্যাহত রয়েছে।পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, মামলার বিপরীতে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। জুলাই-আগস্টে খুনের যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে তা মামলা থেকে। ওই দুই মাসে খুনের ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো তালিকায় দেওয়া হয়েছে। জুলাই-আগস্টে নিহতের ঘটনায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বরেও মামলা হয়েছে। এখনও মামলা হচ্ছে। যে মাসে মামলা হয় সেই মাসের তালিকায় সংখ্যা উঠানো হয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ১ জুলাই শুরু হয়। আন্দোলন ১৫ জুলাই পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ থাকলেও ১৬ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর দমন-পীড়ন বাড়তে থাকে। ১৮ জুলাই থেকে আন্দোলনে গুলি চালানো হয়। তাতে হতাহতের সংখ্যাও বাড়ে। রাজধানীর যে ক টি এলাকায় ছাত্র-জনতার বড় জমায়েত ঘটে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিরপুর, উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী। এসব এলাকায় চরম পর্যায়ে দমন-পীড়ন চালায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ফলে হতাহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঘটে এই তিন এলাকায়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর দেশ ছেড়ে পালানোর পরও পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৭০৮ জন শহীদ হয়েছেন বলে একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে এই তালিকা দেওয়া হয়।গত ২৮ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকমিটি এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত হয়েছে। তালিকায় নাম আসা ১ হাজার ৫৮১ জন শহীদ হয়েছেন বলেই প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
জুলাইয়ের আন্দোলনে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে ৮১ জনের বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয় রায়েরবাজার কবরস্থানে; যা অন্য মাসের তুলনায় দ্বিগুণ। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহেই বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা ছিল ৪৫।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অপরাধের তথ্য পুলিশ নিয়মিত তাদের ওয়েবসাইটে আপডেট রাখে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে ক্রাইম পরিসংখ্যান দেওয়া বন্ধ ছিল প্রায় ৭ বছর। গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদরদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ ওয়েবসাইটে ক্রাইম পরিসংখ্যান বন্ধ থাকার বিষয়টি নতুন আইজিপি বাহারুল আলমকে অবগত করেন সংবাদকর্মীরা। এর কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের ওয়েবেসাইটে ক্রাইম পরিসংখ্যান আপলোড করা হয়।এই দীর্ঘ সময় পুলিশের ওয়েবসাইটে ক্রাইম পরিসংখ্যান দেওয়া বন্ধ থাকায় ছয় বছরের তথ্য বৃহস্পতিবার একবারে আপলোড করা হয়। ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত হালনাগাদ করা হয় তথ্য। ক্রাইম পরিসংখ্যানে খুন-সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯ থেকে গত আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে ১৯ হাজার ৪০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ৩ হাজার ২৩ জন।এই বছরে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের আওতায় ১৩ জেলায়, ৬৭০ জন। রাজধানীতে খুনের সংখ্যা ১৬৫। ২০২২ সালে ৩ হাজার ১২৬ খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সংখ্যায় বেশি ঢাকা রেঞ্জে। রাজধানীতে খুন হন ১৭২ জন। ২০২১ সালে খুনের ঘটনা ঘটে ৩ হাজার ২১৪টি, এর মধ্যে রাজধানীতে নিহত হন ১৬৬ জন। ২০২০ সালে নিহত হন ৩ হাজার ৫৩৯ জন, যার মধ্যে রাজধানীতে ২১৯ জন। এ বছর বেশি খুনের ঘটনা ঘটে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের আওতায় ১১টি জেলায়, ৭২৭ জন। ২০১৯ সালে খুনের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৫৩। এ বছরও বেশি খুনের ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম রেঞ্জে ৭৭৭।
তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ঢাকাসহ সারাদেশে খুন হয়েছে ২ হাজার ৪৮৫ জন। জুলাইয়ে ৩৩৪ জন এবং আগস্টে ৬১৮ জন। এর মধ্যে জুলাইয়ে রাজধানীতে খুনের সংখ্যা ৫৯ এবং আগস্টে ১১৯। জুলাইয়ে চট্টগ্রাম মহানগরে ১০ ও গাজীপুর মহানগরে সাতজন মারা যান। আগস্টে চট্টগ্রাম মহানগরে ২০ এবং গাজীপুরে ১৭ জন নিহত হন।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হামলা ও গুলি চালিয়ে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয় রাজধানীসহ সারাদেশে। জুলাই ও আগস্টে ৯৫২ জন যে নিহতের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোও শুধু আন্দোলনের ঘটনায় নয়; পারিবারিক, সন্ত্রাসী বা দুর্বৃত্তদের হাতে নিহতের সংখ্যাও রয়েছে তাতে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সারাদেশে জুনে খুনের সংখ্যা ২৬৮, মে ২৫৯, এপ্রিলে ২৯৬, মার্চে ২৩৯, ফেব্রুয়ারিতে ২৪০ ও জানুয়ারিতে ২৩১।