দেশে এখন গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও সরকারিভাবে বলা হয় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। তবে কমবেশি গড় সরবরাহ বর্তমানে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মধ্যে। এদিকে শত শত শিল্প-কারখানা গ্যাসের সংযোগের অপেক্ষায়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতেও গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। তারা গ্যাসের লোড বৃদ্ধির অপেক্ষায় বছরের পর বছর ঘুরছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর অফিসে অফিসে। ফলে কার্যত গ্যাস সংকটের কারণে সবই চলছে ধীরগতিতে। এ যখন অবস্থা তখন দিন দিন কমছে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান।পরিস্থিতি উত্তরণে খুব বেশি আশা তৈরি হচ্ছে না দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে। গ্যাসের চাহিদা পূরণে নির্ভর করতে হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এলএনজির ওপর। তবে সেখানেও রয়েছে প্রচণ্ড সংকট। কারণ বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ডলারের সম্পর্ক রয়েছে, যে সংকট এখনও কাটেনি। সব মিলিয়ে শিল্প-বাণিজ্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করতে দেশের জ্বালানির জোগান বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাপেক্সের আওতাধীন গ্যাস কূপগুলো থেকে প্রতিদিন ১১৭ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডসের কূপগুলো থেকে প্রতিদিন উত্তোলন করা হচ্ছে ৫৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট, সিলেট গ্যাস ফিল্ডের কূপগুলো থেকে উত্তোলন করা হয়েছে ১৩০ দশমিক ৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অক্টোবর পর্যন্ত সব গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গড়ে দৈনিক উত্তোলন করা হয়েছে ১০৩৯ এমএমসিএফডি ঘনফুট। সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাকি সময়টাতে দৈনিক গড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ বা উত্তোলিত হবে মাত্র ৭১৭ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এসব উৎস ছাড়াও যেসব বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশের অন্যান্য কূপগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন করে সেগুলো এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এলএনজি যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে।এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিগত এক দশক ধরেই গ্যাসের সংকট চলছে। নানা চেষ্টা করার পরও আসলে কাক্সিক্ষত মাত্রায় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, একটা বিষয় লক্ষ করলে দেখবেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশীয় গ্যাসের উৎস বা জোগানের বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে এলএনজি টার্মিনাল বা এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকেছিল। তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশীয় উৎস থেকে পর্যাপ্ত গ্যাসের জোগান নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। যদি ভবিষতে বড় কোনো ক্ষেত্র পাওয়া যায় সেটা অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো। কিন্তু তা না পেলেও তো দেশের শিল্প-কারখানার অগ্রগতি বা অর্থনৈতিক গতি ঠিক রাখতে অবশ্যই গ্যাসের জোগান বা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা স্থির না হওয়ায় এ সেক্টরে সংকট আরও প্রকট হতে যাচ্ছে। কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীরাই সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে সামনের দিনগুলোতে জ্বালানির জোগান বিশেষ করে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের জোগান ঠিক রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।অন্যদিকে, দেশে গ্যাস সংকট বেড়েই চলছে। দৈনিক গ্যাসের ঘাটতি প্রায় দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসস্বল্পতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে শিল্প খাত। চাহিদার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম গ্যাস পাচ্ছে শিল্প-কারখানা। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, চট্টগ্রাম, নরসিংদীসহ দেশের শিল্পাঞ্চলগুলোতে এই সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।গ্যাস সংকটে ব্যাহত হচ্ছে কারখানার উৎপাদন। অনেক কারখানা হুমকিতে, আবার কোনোটি বন্ধের পথে। বাধ্য হয়ে শ্রমিক ছাঁটাই করছেন মালিকরা। উৎপাদন কম হওয়ায় কমছে পণ্য রপ্তানি, বিদেশ থেকে বাড়ছে কাঁচামাল আমদানি। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ছে। গ্যাস সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে অর্থনীতিতে অশনিসংকেত দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।এদিকে গ্যাস সংকটের বিষয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, গত আওয়ামী লীগ সরকার গ্যাস অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানির দিকেই বেশি নজর দিয়েছিল। তাই সংকট বেশি ঘনীভূত হয়েছে। গ্যাস সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। তিনি বলেন, দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করে উদ্বৃত্ত গ্যাস শিল্প খাতে সরবরাহ করা সম্ভব। এতে সংকটের একটা সুরাহা হবে। কারণ দেশের রিজার্ভের যা অবস্থা, এতে এলএনজির ওপর বেশি নির্ভর করা যাবে না।