
দেশের বিশাল উপকূলীয় এলাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলকে বঙ্গোপসাগর হতে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করে উপকূলীয় বনভূমি। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় হারিকেন থেকে শুরু করে সিডর, আইলা, মহাসেন, আম্পান ও ইয়াসের মতো বড় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিহত করতে বিশাল উপকূলীয় বন প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু সেই বনভূমি এখন নিজেই ঝুঁকির মুখে। ১৯৬৬ সাল থেকে যে প্রায় সোয়া ২ লাখ হেক্টর উপকূলীয় বনভূমি সৃজন করা হয় তার অন্তত ৩০ শতাংশ ইতোমধ্যে বিনষ্ট ও বেদখল হয়ে গেছে। এমনকি এসব বনভূমি প্রতিটি ঝড়ঝঞ্ঝায় উপকূলভাগের বিশাল জনগোষ্ঠীসহ সম্পদের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখলেও এর উন্নয়ন কিংবা নতুন বন সৃজনে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এতে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে আছে দক্ষিণাঞ্চলবাসী।এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ১৮৭৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর থেকে অন্তত অর্ধশতাধিক তীব্র ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও ৪৯ বার ঘূর্ণিঝড় ও ২০ বার হারিকেন মাত্রার ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছে।
পরিবেশবিদদের মতে, ভূখণ্ড উদ্ধারের চেয়েও সৃজিত বনভূমি বেশি ইতিবাচক ভূমিক রাখছে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে উপকূলভাগকে রক্ষায়। তাই উপকূল রক্ষায় আরও বেশি বন সৃজনের তাগিদ দেন তারা।বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালে সিডরে বরিশাল অঞ্চলের উপকূলভাগসহ মূল ভূখণ্ডের প্রায় এক কোটি গাছপালা বিনষ্ট হয়। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে উপকূলীয় বনের প্রায় সাড়ে ১১ হাজার হেক্টরের গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে প্রায় ১২ হাজার হেক্টরের বন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর সবশেষ ২০২৩ সালের মে মাসের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সাড়ে ৬ হাজার হেক্টরের ম্যানগ্রোভ বাগান, পৌনে ২শ হেক্টরের স্ট্রিপ, গোলপাতা ও ঝাউ বাগান ছাড়াও নার্সারিসমূহের প্রায় দেড় লাখ চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।তবে পাঁচ বছর আগে ১০৪ কোটি টাকায় বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে বনায়ন নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ২৫ হাজার হেক্টরে নতুন বনায়নসহ এক হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবঁাঁধ ও বিভিন্ন সড়কে বৃক্ষ রোপণের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। উপকূলের ১০টি জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধিসহ সোয়া ৩ কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ৪০ হাজার বসতবাড়িতে বনায়নের লক্ষ্যে গাছের চারা বিতরণ করা হয়।
সরকার বঙ্গোসাগরের কোল ঘেঁষে দেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখার ১৯টি জেলার ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে উপকূলীয় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যা দেশের মোট আয়তনের ৩০ শতাংশ। আর মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ মানুষ এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাস করে। উপকূলীয় এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীসহ সম্পদ রক্ষায় ১৯৬৬ সাল থেকে যে বনায়ন শুরু হয়, তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় উপকূলভাগে ইতিপূর্বে দুই লক্ষাধিক হেক্টর সরকারি খাসজমিতে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সহ বিভিন্ন ধরনের বনায়ন করা হয়েছে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিহত করতে গিয়ে উপকূলীয় বনভূমিও অনেকটা ক্ষতবিক্ষত। সিডরের ক্ষতি পূরণের আগেই পরবর্তী ৩ বছরে ঘূর্ণিঝড় মহাসেন ও আইলা উপকূলীয় বন-বাগানসহ বিশাল জনপদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে।প্রায় পাঁচ বছর আগে ভারত, ব্রাজিল ও মালয়েশিয়ার কয়েকজন গবেষক সুন্দরবনসহ বরিশাল অঞ্চলের উপকূলীয় বন-বাগান পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। তাদের গবেষণা ফলাফল আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এলসেভিয়ায়ের এস্টুয়ারিন, কোস্টাল অ্যান্ড সেলফ সায়েন্স জার্নাল -এ প্রকাশিত হয়েছিল। গবেষণাপত্রে আম্পানসহ সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলোতে বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের বনের ক্ষতি ৫৬.১৯ শতাংশ এলাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এমনকি আম্পানের কারণে উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনের সব অংশেরই অবনতিসহ ভাঙন দেখা দিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ১৪৪ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি হ্রাস পেয়েছে।