
রাশিয়ার ভূমিকম্পের আগে মঙ্গলবার রাতে দেড় ঘণ্টার মধ্যে বঙ্গোপসাগরে পরপর চারটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রাশিয়া কিংবা বঙ্গোপসাগরের ভূমিকম্পের মধ্যে কোনো যোগসূত্র এবং দেশের জন্য কোনো বার্তা দিচ্ছে কিনা, এসব বিষয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক।বঙ্গোপসাগর ও রাশিয়ার ভূমিকম্পের বিষয়ে হুমায়ুন আখতার বলেন, মঙ্গলবার গভীর রাতে বঙ্গোপসাগরে পরপর চারটি ভূমিকম্প অনুভূত স্বাভাবিক ঘটনা। রাশিয়ার ভূমিকম্পের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের ভূমিকম্পের কোনো সংযোগ নেই। দুটি ভিন্ন জোনে সংঘটিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে ভূমিকম্প নিয়মিত ঘটনা হলেও আমাদের দেশের জন্য চিন্তার বিষয়। বঙ্গোপসাগরে ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ২৭৫ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রতলের ১০ কিলোমিটার গভীরে। এই ভূমিকম্প ইন্ডিয়া (ভারত) ও বার্মা (মিয়ানমার) প্লেটের সংযোগস্থলে হয়েছে।
২০০৩ সাল থেকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণায় উঠে আসা ১২ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই গবেষক বলেন, ২০১৬ সালে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ফলাফলে দেখা গেছে, সাবডাকশন জোন সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। এই রেখা ভারতের প্লেট, যেটি পশ্চিমে অবস্থিত, সেটি পূর্বের যে পাহাড়ি অঞ্চল, তার নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। এই জোনের মধ্যে আবার দুটি ভাগ আছে। একটি হলো লক জোন, যেটি আমাদেরই অংশ। সেখানে ভারত ও মিয়ানমারের প্লেট আটকে আছে, একটির সঙ্গে আরেকটি।এ ছাড়া আরেকটি জোন হলো আমাদের পূর্ব দিকের অঞ্চল, যেটি মিয়ানমার ও মিজোরাম অঞ্চলে। এই জোনে বিপুল শক্তি প্রায় হাজার বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে আছে। এতে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার পর্যন্ত ভূমিকম্প হতে পারে। আমার গবেষণা মডেলে উল্লেখ করেছিলাম, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও মিয়ানমার এই তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ভূতাত্ত্বিক কাঠামো অনুযায়ী বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে একটি হলো ভারত প্লেট। এর পূর্বদিকে মিয়ানমার প্লেট এবং উত্তরে এশিয়া প্লেট। ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থল সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর হয়ে মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে সুমাত্রা পর্যন্ত চলে গেছে। প্লেটের সংযোগস্থলে ৮০০ থেকে ১০০০ বছর আগে ভূমিকম্প হয়েছিল। ফলে এই সময়ে এই অংশে যে পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে, সেটি যদি একসঙ্গে বের হয়, তাহলে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তাঁর ব্যাখ্যায়, ঘন ঘন কম মাত্রার যে ভূমিকম্পগুলো হচ্ছে, সেগুলো ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প তৈরি হওয়ার মতো যে শক্তি ভূতকের মধ্যে জমা হয়ে আছে, এই শক্তিটা বের হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশ কম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হলেও ঝুঁকির দিক দিয়ে খুব ওপরে রয়েছে। যে পরিমাণ শক্তি ইন্ডিয়ান-বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে জমা হয়ে আছে, সেই শক্তিটা যদি বের হয় তাহলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এটি আগামীকালও হতে পারে, আগামী ৫০ বছর পরেও হতে পারে। কখন হবে, সেটি আমরা বলতে পারি না। তবে যেটি হবে, সেটি খুব মারাত্মক হবে। সাবডাকশন জোনের ভূমিকম্পগুলো ভয়ংকর হয়।তিনি তথ্য দিয়েছেন, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টি এ সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ভূত্বক গঠনকারী প্লেটগুলোর সঞ্চারণের ওপর। পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০-১০০ কিলোমিটার পুরুত্বের লিথোস্ফিয়ার ছোট-বড় ১৩টি খণ্ডে (প্লেটে) বিভক্ত। উত্তপ্ত ও নরম অ্যাস্থোনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান এ প্লেটগুলো গতিশীল। এ গবেষক বলেন, বাংলাদেশের উত্তরে আছে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল; পূর্বে বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় বাংলাদেশ ভূখণ্ড ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে।বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠন বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশের মধ্যে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাব্য ফাটলগুলোর একটি সিলেট-মেঘালয় সীমান্তের ডাউকি ফল্ট এবং চট্টগ্রাম উপকূল বরাবর সীতাকুণ্ড-টেকনাফ ফল্ট। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সমতল ভূমিতে অসংখ্য ফাটল রয়েছে, যা থেকে ভূমিকম্প হতে পারে। ঢাকার পূর্বে, পশ্চিমে, উত্তরে ও দক্ষিণে, অর্থাৎ চারপাশেই ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো ফাটল আছে।