২০১৬ সালের অক্টোবরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে, বিশেষ করে মুসলমানদের নির্যাতন ও হত্যা শুরু করলে প্রায় এক বছরের মধ্যে ১০ লাখের ওপর রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সেই যে এলো, চার বছর পার হয়ে গেল। ছেড়ে আসা ভিটামাটিতে তাদের আর ফেরা হয়ে উঠল না। এরই মধ্যে কয়েকবারই আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়েছে; এমনকি তাদের সরকারের লোকজন এসে কথা বলে গেছে, তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে। অথচ আজও তারা ফিরতে পারেনি। কেউ কথা রাখেনি।বিগত চার বছরে বাংলাদেশ শুধু দ্বিপক্ষীয়ভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনসহ সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও এ সমস্যা নিরসনের জন্য নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমারের এ নৃশংসতায় বিশ্বসমাজও নিশ্চুপ বসে থাকেনি, তারাও রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসন ও রোহিঙ্গা গণহত্যার ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক সংস্থা ও সংগঠন, বিশেষ করে জাতিসংঘ, ইসলামিক সংস্থা, আসিয়ান, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে; নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও রাখাইনে গণহত্যার বিচারের দাবি তুলেছে। কয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের সব দেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে।এদিকে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব সব কিছুই যেন একেবারে গুলিয়ে দিল। এমনিতেই মিয়ানমার নানা ছলচাতুরী ও টালবাহানা করে সময় পার করার ফন্দি এঁটে যাচ্ছিল।
বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণ এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের জন্য শাপে বর হয়েছে। মিয়ানমারকে এখন আর কিছু করতে হচ্ছে না। বিষয়টির গুরুত্ব অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। বিশ্বনেতাদের করোনা এতটাই ব্যস্ত রেখেছে যে এমনিতেই সবাই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কথা বা মিয়ানমারের গণহত্যার কথা স্থায়ীভাবে না হলেও আপাতত ভুলের বা পরে দেখা যাবের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে শুধু ১০-১২ লাখ লোকের বোঝা টেনে নেওয়াই না, নিরাপত্তা হুমকির কথাও ভাবতে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে হার তাতে নিকট ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বেড়ে যখন কোটিতে দাঁড়াবে, তখন সেই বোঝা বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে খুবই কঠিন হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।সব কিছুর পরও আমরা আশাবাদী এবং আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সহমত, রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফিরিয়ে নিতে হবে, তাদেরকে তাদের ভিটামাটিতে পূর্ণ সম্মান ও নিরাপত্তা দিয়ে পুনর্বাসন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। মিয়ানমারের সব ছলচাতুরীর অবসান ঘটিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ওদের ছলনা আর টালবাহানার সমাপ্তি ঘটাতে শিকড় কর্তন করতে হবে। আর এ কাজটি যত তাড়াতাড়ি করা যায়, ততই মঙ্গল। আর এ সব কিছু বিশ্বসম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়েই করতে হবে। আমরা অবশ্যই চাইব না, বাংলাদেশ মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের স্থায়ী আবাস হোক। রোহিঙ্গারা শিগগিরই তাদের ভিটামাটিতে ফিরে যাক এবং সেখানে নিরাপদে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে সম্মানের সঙ্গে বসবাস করুক এটিই আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা।