বেড়েছে AI কম্পিউটারের বাজারশিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধালেবাননে ইসরায়েলের ৮ শতাধিক সেনা নিহতদেশে গ্যাস উৎপাদন কমছেচালানোর সক্ষমতা নেই এমন কারখানা বন্ধ করা হবে
No icon

মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক অন্ধকার যুগ : আন্তর্জাতিক আইনে গুম-খুনের বিচার প্রয়োজন

মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে জঘন্য রূপ হচ্ছে কাউকে জোরপূর্বক গুম। আন্তর্জাতিক আইনে গুম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলেও ফ্যাসিবাদী সরকার রাষ্ট্রীয় মদদে অপহরণ ও গুমের একটি নির্মম কালো অধ্যায় তৈরি করেছে বাংলাদেশে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে নিখোঁজ হওয়াকে জাতিসংঘ এনফোর্সড ডিসপিয়ারেন্স কনভনেশনে জোরপূর্বক গুম বলা হয়েছে। এটি এমন এক বিষাক্ত হাতিয়ার যা ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে একরকম ভয় সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক আইনে এসব গুমের সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তির কথা বলেছে। এই জঘন্য কাজটি কেবলমাত্র একটি নিপীড়নমূলক সরকার ব্যবস্থায় লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জোরপূর্বক অপহরণ ও গুমের ঘটনা মধ্যযুগীয় অন্ধকার যুগকে হার মানিয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে পুলিশের দ্বারা যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। তবে তারা এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করেনি বরং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা, গুম ও খুনের একটি কালো জনপদে পরিণত করেছে বাংলাদেশকে। এসকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কঠোরভাবে সমালোচিতও হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।

বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জীবন সুরক্ষার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হলেও সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিসমূহের অনুশীলন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে তলানিতে নেমেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম, খুন ও গণহত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিপক্ষকে দমন করে ক্ষমতা সুসংহত করতেই গত ১৬ বছর ধরে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছে।

সব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চমাত্রায় রাজনীতিকরণ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আইনের আওতায় কাজ না করে ক্ষমতাসীন এলিটদের আদেশ মেনে কাজ করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নানা উপায়ে ফ্যাসিবাদী কায়দায় আওয়ামী সরকার দীর্ঘ ষোল বছর জনগণের অধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন করেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহে তীব্র রাজনীতিকরণ, অর্পিত ক্ষমতার ধারাবাহিক অপব্যবহার, ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শাসক গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ধারাবাহিক ব্যবহার করে অপহরণ, জোরর্পূবক গুম ও খুনের মাধ্যমে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করেছে।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, গণমাধ্যম এবং নিহতদের পরিবার প্রায়ই দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুমের ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের মদদে গুম, খুন ও গণহত্যা এখন প্রমাণিত। জোরপূর্বক অপহরণ করে শেখ হাসিনার সিক্রেট কারাগার আয়নাঘরে আটকে রাখা হয়েছে অনেককে। সেখান থেকে সাম্প্রতি কেউ কেউ ফিরেও এসেছেন। বাংলাদেশের নেতৃত্বস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিখোঁজের ঘটনা শুরু হয় ২০০৯ সালে। গত ১৬ বছর ধরে এ ধরনের ঘটনা দিনে দিনে বেড়েই চলেছিল। অধিকারের তথ্যমতে, গত ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ২ হাজার ৬৯৯টি। তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেয়ার বছর ২০০৯ সালে হত্যার শিকার হন মোট ১৫৪ জন। এছাড়া ২০১০ সালে ১২৭ জন, ২০১১ সালে ৮৪, ২০১২ সালে ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২৯ জনে। আর নির্বাচনের বছর ২০১৪ সালে ১৭২ জন, ২০১৫ সালে ১৮৬, ২০১৬ সালে ১৭৮, ২০১৭ সালে ১৫৫ জনকে হত্যা করা হয়।

২০১৮ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয় ৪৬৬ জনকে। ২০১৯ সালে ৩৯১ জন, ২০২০ সালে ২২৫ জনকে হত্যা করা হয়। এ দেড় দশকে ৬৭৭ জন গুমের শিকার হন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৮ জন গুমের শিকার হন ২০১৮ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। এই সংখ্যা শুধুমাত্র পত্রিকায় রিপোর্ট হওয়ার ভিত্তিতে। অসংখ্য গুমের ঘটনা রিপোর্টেড হয়নি মিডিয়ায় ফ্যাসীবাদী নিয়ন্ত্রণের কারণে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো এ গুম, অপহরণ এবং হত্যার ঘটনাগুলো সঠিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের পরিবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল। এ ধরনের গুমের ঘটনার  মাধ্যমে শুধুমাত্র যে বিরোধী পক্ষ এবং সমালোচকদের ভয় দেখিয়ে চুপ করতে বাধ্য করেছিল তা নয় বরং স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে সক্ষম সাধারণ নাগরিকদেরও কণ্ঠরোধ করেছিল।

গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই এখনো নিখোঁজ।  ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের একজন জনপ্রিয় ওয়ার্ড কমিশনার মোহাম্মদ চৌধুরী আলম, জুন ২০১০ সালে নিখোঁজ হন। তাকে র‍্যাব দ্বারা আটক করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়। তিনি কোথায় আছেন তা এখনো অজানা। বিএনপির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হয়েছেন। এ নিখোঁজের তালিকায় আরো অনেক রাজনৈতিক কর্মী, ব্যবসায়ী, ছাত্র এবং  অন্যান্য মানুষ। নারায়ণগঞ্জে র‍্যাব-১১ কর্তৃক তুলে নিয়ে সেভেন মার্ডারের কথা এ দেশের মানুষ এখনো ভুলতে পারেনি।


বাংলাদেশের জোরপূর্বক অপহরণ ও গুমের ঘটনা নিয়ে আমার একটি গবেষণা ২০২০ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে  বিখ্যাত পুলিশিং জার্নালে প্রকাশ করা হয়। এই গবষেণার প্রায় ৭৫% উত্তরদাতারা মতামত দেন যে, আওয়ামী লীগ আমলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা অপহরণ এবং গুমের সাথে সরাসরি জড়িত। এছাড়াও অজ্ঞাত স্থানে মানুষকে আটকে রাখা এবং গোপনীয় হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করা তাদের নিত্যদিনের কাজ ছিল দাবি করেন তাঁরা। গবেষণাটিতে উত্তরদাতাদের মাত্র ১০.৬৭% ভিন্নমত পোষণ করেছেন।

যেহেতু গুমের ঘটনায় সুনির্দিষ্ট  কাউকে অভিযুক্ত করা যায় না এবং কোনো সাক্ষী থাকে না;  মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত  করতে পারে না। তাই সকলেই এক ধরনের অনিশ্চিত দোলাচলের মধ্যে জীবনযাপন করতে থাকে। বল প্রয়োগের মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল ফ্যাসিবাদীদের অন্যতম কৌশল। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো- গুম হওয়া ব্যক্তির কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায় না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে লাশও পাওয়া যায় না। যার ফলে ভিকটিমের পরিবারের অপেক্ষায় দিন কাটে কখন ভিকটিম ফিরে আসবেন। গুম শুধুমাত্র ভিকটিমকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসহায় করে ফেলে তা নয়। গুমের কারণে ভিকটিমের অনুপস্থিতিতে ভিকটিমের পরিবারকে মানসিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে তাদের দুঃখের সীমা থাকে না। ইলিয়াস আলীর পরিবার  বিশ্বাস ও অপেক্ষায় ছিলেন যে, তিনি হয়তো ফিরে আসবেন। শেখ হাসিনার সিক্রেট জেলখানা থেকে মুক্তি পাবেন! আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো একটি নিরাপদ কৌশল হিসাবে অপহরণ ও গুমের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই পদ্ধতি চালু করেছিল বিগত হাসিনা সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে।

জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত কনভেনশনে জোরপূর্বক গুমের সাথে যুক্ত ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত, বিচার এবং শাস্তির প্রক্রিয়ার উপর জোর দেয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যথাযথভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত  করার কথা বলা হয় এই কনভেনশনে। তবে, এ জাতীয় প্রক্রিয়াগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নির্ভর করে সিগনেটোরি রাষ্ট্রগুলোর উপর। বাংলাদেশে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অপহরণ ও জোরপূর্বক  গুমের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ তদন্ত অনুপস্থিত ছিল। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র‍্যাব এবং পুলিশের তথাকথিত বিভাগীয় নির্বাহী তদন্তের  মাধ্যমে এই লঙ্ঘনগুলোকে বৈধ এবং যুক্তিযুক্ত করেছিল গত স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের নির্দেশনায় । তবে সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। গত সরকারের আমলে জোরপূর্বক সকল গুম, খুন ও গণহত্যার সঠিক তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব। অতীতের এই ঘটনাগুলোর বিচার না হলে যে কোনো সরকারের আমলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকবে।  

জোরপূর্বক গুম সংক্রান্ত জাতিসংঘের কনভেনশন অনুসারে, প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে এই ধরনের জঘন্য ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার করার দায়িত্ব এবং উদ্যোগ নিতে হবে । শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশকে একটি নরকে রূপান্তরিত করেছিল। তারা এই ধরনের ঘটনার কোনো বিচার করেননি। বিচারই বা করবেন কেন তারা নিজেরাই এ ধরনের ঘটনার নির্দেশ দিয়েছেন।

এ সংক্রান্ত আমার গবষেণায় আরও দেখানো হয়েছে যে একজন বিরোধী দলের  নেতা, কর্মী বা সমর্থকরা সবসময় মিথ্যা বিচারের এবং খামখেয়ালি  গ্রেপ্তারের  আতঙ্কে থাকত হাসিনা সরকারের আমলে। দেশে আইন ছিল, কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ না হয়ে অপপ্রয়োগ হয়েছে সর্বক্ষেত্রে।  নিখোঁজ  হওয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করতে মানুষের ভয় ছিল চরম মাত্রায়। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন। তাই তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস পাননি। তবে তারা এখন আশাবাদী। তারা এর বিচার চান। গবেষণার ফলাফলে  দেখানো হয় যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দায়মুক্তির  সংস্কৃতির কারণে অপরাধীদের বিচারের আওতায় এতোদিন আনা হয়নি। ভুক্তভোগীর পরিবারও  বিচার চেয়ে আদালতে যেতে চায়নি। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে সুবিচার নিশ্চিত করা জরুরি। ‌যদি বর্তমান আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনা কঠিন হয় সেক্ষেত্রে আইনের সংস্কার করে হলেও এ সকল মানবতাবিরোধী অন্যায়ের বিচার করা উচিত।

একটি সরকার যতক্ষণ না সুশাসন এবং মানবাধিকারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিকার পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা থাকবে না। হাসিনা সরকার তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই মানবাধিকার রক্ষার জন্য জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের কাঠামোতে মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করা উচিত। এছাড়া বলপূর্বক গুম হওয়াকে আইনত একটি ফৌজদারী অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা উচিত যেখানে ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষা এবং প্রতিকার প্রদানের সাথে এই ধরনের জঘন্য কাজ এখনই বন্ধ  করা উচতি। রাষ্ট্রীয় কায়দায় গুম, খুন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে এই ধরনের যেকোনো কাজের জন্য অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে অপরাধীরা কোনোভাবেই ছাড় পাবে না। সব অবস্থায় তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা। 

লেখক- অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়