রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এরই মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি স্ম্ফীত হয়ে উঠছে। সামরিক-বেসামরিক মানুষের লাশের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে বাস্তুচ্যুত ইউক্রেনীয়র সংখ্যা। বলা বাহুল্য, এ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে গোটা ইউরোপে এক ধরনের নাড়া ও সাড়া পড়েছে। বিশ্নেষক, রাজনীতিবিদসহ অনেকেই একে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বলে অভিহিত করেছেন। আমরা দেখেছি, পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর একের পর এক কঠিন অবরোধ আরোপ করেছে। এ যুদ্ধ স্বাভাবিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক নতুন যুগেরও সৃষ্টি করেছে। একদিকে পশ্চিমাদের জোটবদ্ধ হওয়া, অন্যদিকে রাশিয়ার দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধে নামার মানে হলো নতুন শীতল যুদ্ধ শুরু হওয়া; যেটা আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেখেছি।এ কারণেই বিষয়টি বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব যেমন সরাসরি বাংলাদেশের ওপর পড়তে পারে, তেমনি বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনায় পরোক্ষভাবেও আমাদের প্রভাবিত করতে পারে। বস্তুত বিশ্বায়নের এ যুগে দুটি দেশের মধ্যকার যুদ্ধ কেবল সংশ্নিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে সীমিত থাকে না; বরং অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। বলা বাহুল্য, বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক যে কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই বাংলাদেশের ওপর যুদ্ধের প্রভাব পড়বে তৎক্ষণাৎ এবং স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে।ইউক্রেনে হামলার পরপরই বাংলাদেশ সরকার সে দেশে বসবাসরত প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশির মধ্যে যারা দেশে ফেরত আসতে চান, তাদের আনতে উদ্যোগ নেয়। এরই মধ্যে ইউক্রেনে আটকে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ ;এমভি বাংলার সমৃদ্ধির ২৮ নাবিক দেশে ফিরেছেন। রুশ হামলায় নিহত নাবিক হাদিসুর রহমানের মরদেহও সরকারের উদ্যোগে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।বস্তুত ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলা বাংলাদেশকে দোটানায় ফেলে দিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়া একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ওপর যেভাবে হামলা করেছে, তা নিন্দার্হ।
আমরা দেখেছি, এ মাসের শুরুতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করেছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। প্রস্তাবে রাশিয়াকে অবিলম্বে ইউক্রেন থেকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। জরুরি অধিবেশনে পাস হওয়া ওই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল ইরান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ ৩৫ দেশ। যদিও সম্প্রতি এমন আরেকটি প্রস্তাবে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ। ইউক্রেনে মানবিক সংকট নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে বাংলাদেশ ভোট দেওয়ার দুদিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মানবিক কারণেই তারা এর পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এ থেকে অনেকে যদিও বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু আমি মনে করি, এটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং এটি বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির আলোকে কোনোদিকে না ঝুঁকে একটা ভারসাম্য তৈরি করেছে।বলার অপেক্ষা রাখে না, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ব-অর্থনীতি ভালো অবস্থানে নেই। রাশিয়ার সুইফট সুবিধা বাতিলকরণ ও বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতিতে যে মন্দাবস্থা এবং শেয়ার মার্কেটে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব বিশ্ব-অর্থনীতিতেও পড়তে শুরু করেছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরেও আসছে। বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে; যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সেখানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক নয়।