
মিয়ানমার ঘিরে বড় শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে অনেক দিন ধরেই। আগে থেকেই দেশটিতে চীনের উপস্থিতি রয়েছে। এদিকে কয়েক যুগ ধরে নেপিদোতে নিজ অবস্থান তৈরি করতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন ও গণহত্যার কারণে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবারও মিয়ানমারে নিজ অবস্থান শক্ত করতে মনোযোগ দিয়েছে ওয়াশিংটন। তুলে নেওয়া হয়েছে জান্তা সরকারের একাধিক জেনারেল ও তাদের সহযোগীদের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞা। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড, জাতিগত নিধন ও গণহত্যার মতো অপরাধের জের জান্তা সরকারের একাধিক জেনারেল এবং তাদের ঘনিষ্ঠদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বিশ্বে মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া দেশগুলো। এর ভেতর যুক্তরাষ্ট্রও ছিল। তবে সম্প্রতি মিয়ানমারের জান্তাঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে ওয়াশিংটন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের মতে, মিয়ানমারের বিরল ধাতুর ওপর মার্কিন চোখ অনেক আগে থেকেই। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় এসব বিরল ধাতুর চাহিদা প্রচুর, যার সম্পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছে চীন। সম্প্রতি কোয়াড বৈঠকে চীনের এ বিরল ধাতু সংগ্রহের বিষয়ও উদ্বেগের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
রোহিঙ্গা ইস্যু ছাপিয়ে মিয়ানমার ঘিরে বড় শক্তিগুলোর এক প্রকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার ওয়াশিংটনে বড় ধরনের ও শক্তিশালী লবিস্ট নিয়োগ করেছে। পাশাপাশি নিজ দূতাবাসকেও শক্তিশালী করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দুই পক্ষ থেকেই সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া এবং স্বাভাবিক করার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে ঝুঁকিতে পড়বে দেশটির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা। পাশাপাশি দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য জবাবদিহি ও প্রত্যাবাসন দুই-ই ঝুঁকির মুখে পড়বে।মিয়ানমার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থকে ঘিরে। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে মিয়ানমার হলো চীনের জন্য বঙ্গোপসাগরে পৌঁছানোর একটি কৌশলগত দরজা। ফলে এ বিষয়টি মাথায় রেখে কিউকফু পাইপলাইন ও রেলপথের মতো বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের আওতায় চালু করেছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বেইজিং সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে চায়। ফলে বড় অবকাঠামোয় বিনিয়োগের মাধ্যমে চীন মিয়ানমারের গ্যাস, খনিজ, কাঠ অহরণে সক্রিয়ভাবে জড়িত।
চীনকে ঠেকানোর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে আগের অবস্থান গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে থাকলেও দেশটি সেখান থেকে সরে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চাপ প্রয়োগ করা হলেও তাতে নেপিদোকে কাবু করতে পারেনি ওয়াশিংটন। এখন নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রত্যাহারের মাধ্যমে অবস্থান তৈরি করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। যাতে দেশটির বিরল খনিজের সুবিধার পাশাপাশি চীনকে নজরে রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই চায়, মিয়ানমার যেন চীনের একচ্ছত্র প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসে। যাতে মার্কিন বড় বিনিয়োগকারীরা সেখানে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারে।
মিয়ানমার চীনের বিরল খনিজ সরবরাহের বড় একটি উৎস। আর বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের প্রতিযোগিতায় প্রধান লক্ষ্য হলো খনিজ পদার্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা। এতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র-সংক্রান্ত সব বিষয় উপেক্ষা করে সম্পর্ক স্বাভাবিকের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। এ কারণে মিয়ানমার নিয়ে মার্কিন নীতিরও পরিবর্তনের ইঙ্গিত রয়েছে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন মিয়ানমার নীতি পরিবর্তনের দাবি নাকচ করেছে।