পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম মুফতি তারিক মাসুদ ৯ দিনের সফরে বাংলাদেশেইরান-পাকিস্তান সীমান্তে ৩৩ বাংলাদেশি আটকবাংলাদেশকে বড় লক্ষ্য দিল পাকিস্তানথাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘর্ষ নিয়ে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১২ জন নিহত হয়েছে৪৯ আরোহী নিয়ে রাশিয়ার উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
No icon

মানিকজোড় ভাইবোন কবরেও পাশাপাশি

ভাই-বোনের মধ্যে ছিল খুব ভাব। বড় বোন তাহিয়া আশরাফ নাজিয়া (১২) ভাইকে সবসময় চোখে চোখে রাখত। ভাই আরিয়ান আশরাফ নাফিও (৮) বোনকে ছাড়া এক পা ফেলত না। সে কারণেই নিজের ক্লাসে ছুটি হলেও সে মায়ের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল বোনের জন্য।পরে দুপুর ১টার দিকে সে বোনকে আনতে স্কুল ভবনে যায়। তখনই হঠাৎ প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত যুদ্ধবিমানটি এসে বিধ্বস্ত হয়। এতে দুই ভাইবোনই গুরুতর দগ্ধ হয়। সোমবার রাতেই মারা যায় নাজিয়া। এর এক দিনের মাথায় মঙ্গলবার রাতে নাফিও চলে যায় না ফেরার দেশে। রাজধানীর তুরাগের একই কবরস্থানে পাশাপাশি তাদের দাফন করা হয়েছে।জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় শুরু থেকেই নাফির অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। তাকে সারিয়ে তুলতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) সব ধরনের চেষ্টা করা হয়। মঙ্গলবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। একপর্যায়ে রাত সোয়া ১২টার দিকে সে মারা যায়।মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল নাফি, আর নাজিয়া পড়ত ষষ্ঠ শ্রেণিতে। স্বজনরা জানান, পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর তুরাগের রাজাবাড়ী এলাকার বাসায় থাকত নাফি ও নাজিয়া। তাদের বাবা আশরাফুল ইসলাম নিরব সাবেক সেনা কর্মকর্তা। মা তাহমিনা আক্তার গৃহিণী। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলার দৌলতখানের দক্ষিণ জয়নগর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে।

নাফি-নাজিয়ার বাবার বন্ধু হুমায়ুন কবির  বলেন, ছেলের আগে ছুটি হওয়ায় তাকে নিয়ে অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে স্কুল মাঠের একপাশে অপেক্ষা করছিলেন তাহমিনা। এরপর মেয়ের ছুটির সময় হলে তিনি ছেলেকে বলেন, যাও আপুকে নিয়ে এসো। নাফি তার বোনকে আনতে স্কুলভবনে যাওয়ার পরপরই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। ওদের মাসহ অন্যরা ছুটে গেলেও তাৎক্ষণিকভাবে ছেলেমেয়েকে খুঁজে পাননি। পরে উদ্ধারকর্মীরা নাজিয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় সে তার মায়ের মোবাইল ফোন নম্বর দেয়। তারা সেই নম্বরে কল করে বিষয়টি জানান। তবে নাজিয়ার সারা শরীর এমনভাবে ব্যান্ডেজ করা ছিল যে প্রথমে তাকে দেখে চেনার উপায় ছিল না। তাহমিনা কাছে গেলে নাজিয়া বলে, মা আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবা? সেদিন (সোমবার) রাত ৩টার দিকে নাজিয়া মারা যায়। তার শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়েছিল। এর আগে সে বারবার ছোট ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছে। জানতে চেয়েছে ভাইয়ের কী অবস্থা। সে বলেছে, নাফি আমাকে দেখে দৌড়ে না গেলে ওর কিছুই হতো না।

হুমায়ুন কবির জানান, নাজিয়াকে উদ্ধারের বেশ কিছু সময় পর নাফিকে উদ্ধার করা হয়। তাকেও হাসপাতালের বিছানায় খুঁজে পান মা-বাবা। তার অবস্থা ছিল আরও খারাপ। পুরো শরীর খুব বাজেভাবে পুড়েছিল। অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেছে ভাইবোন।নাজিয়ার খালা তানজিনা আক্তার জানান, বিভিন্ন হাসপাতাল খুঁজে তারা বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে পৌঁছান। সেখানে নাজিয়াকে দেখেও তারা চিনতে না পেরে চলে যাচ্ছিলেন। এমনকি চিকিৎসককে বলেছেন যে এটি তাঁর ভাগনি নয়। কিন্তু নাজিয়া নিজেই হাত তুলে খালাকে কাছে ডেকে নেয়।গতকাল বুধবার দুপুরে নাফির লাশ রাজাবাড়ী এলাকার বাসায় নেওয়া হয়। তখন বুকের ধনকে শেষবারের মতো আদর করতে যান ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তাহমিনা। তবে পুড়ে যাওয়া ছোট্ট দেহটায় হাত ছোঁয়ানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না। সেইসঙ্গে সংক্রমণের আশঙ্কায় তাঁকে সরিয়ে নেন স্বজনরা। পরে বাদ জোহর রাজাবাড়ী দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদ কবরস্থানে নাফিকে দাফন করা হয়। এর আগে একই কবরস্থানে মঙ্গলবার দুপুরে দাফন করা হয় নাজিয়াকে।

দুই সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তাদের মা-বাবা। কাঁদতে কাঁদতে মা তাহমিনার চোখ শুকিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যেই তিনি চেতনা হারাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরলেই বারবার ছেলেমেয়ের নাম ধরে চিৎকার করে উঠছেন।ওদের বাবা আশরাফুল ইসলামও ভেঙে পড়েছেন। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দু বার তাকে কাঁধে নিতে হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী জিনিস সন্তানের লাশ। তিনি দুই সন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের বিচার দাবি করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, বিমান উড্ডয়ন এলাকায় বহুতল ভবনের অনুমতি কেন দেওয়া হলো? আর যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ কেন জনবহুল এলাকায় হবে?

এর আগে নাজিয়ার মৃত্যুর পর তাহমিনা বলেন, আমার মেয়ের পুরো শরীর পুড়ে গেছে। সে কথা বলতে বলতেই আমার সামনেই মারা যায়। তবে যতক্ষণ জ্ঞান ছিল, আমাকে বলেছিল, আম্মু অনেক পিপাসা লাগছে। পানি দাও, জুস দাও। আইসক্রিমও খেতে চেয়েছিল। জানতে চেয়েছিল কখন বাসায় যাবে? আমি বলেছিলাম, সকালে যাব। তখন যা খেতে চাইবে তাই দেব। শেষ মুহূর্তে কোনো ওষুধ কাজ না করায় কষ্ট কমাতে ওকে ব্যথানাশক ওষুধ দেন চিকিৎসক। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ধীরে ধীরে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।