
রাজধানীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সংঘবদ্ধ গাড়ি চোরচক্রের ভয়ংকর সিন্ডিকেট। আলাদা দলে তিন কৌশলে গাড়ি চুরি করছে তারা। একটি চক্র অস্ত্র ঠেকিয়ে গাড়ি ছিনতাই করছে। আরেক গ্রুপ লক ভেঙে গাড়ি নিয়ে সটকে পড়ছে। তৃতীয় গ্রুপ অভিনব ফাঁদ পেতে মালিক বা তার প্রতিনিধির সামনে থেকে দামি গাড়ি নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। সম্প্রতি বেশি সক্রিয় টেস্ট ড্রাইভের নামে চোরচক্রের এই গ্রুপটি। এরা শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত। চলন-বলনে অভিজাত ভাব। ইংরেজিতে কথা বলে অর্নগল। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে বোঝার উপায় নেই- গাড়ি চোর। তাদের টার্গেট দামি গাড়ি। গত ৬ মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে টেস্ট ড্রাইভের নামে ৮টি গাড়ি ছিনতাই করেছে চক্রটি।সর্বশেষ গত সোমবার রাতে টেস্ট ড্রাইভের কথা বলে গণভবনের সামনে থেকে সামসুল আলম নামে এক দুবাই প্রবাসীর কোটি টাকা মূল্যের টয়োটা হেরিয়ার গাড়ি (নম্বর-ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৮-১৯১৮) নিয়ে চম্পট দেয় চোরচক্রের দুই সদস্য। এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার কাফরুল থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন গাড়ির চালক জহির আব্বাস। দুদিন পার হলেও গাড়িটি উদ্ধার হয়নি।সামসুল আলমের ভাতিজা বলেন, চালক জহির আব্বাস কাফরুল থানাধীন মহাখালী ডিওএইচএসে থাকেন।
গত সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে পূর্বপরিচিত রাগিব ফারুকের ফোন নম্বর থেকে ফোন করে অচেনা ২ জন যুবক সাদা রঙের ওই টয়োটা হেরিয়ার গাড়িটি কিনতে ডিওএইচএসে আসেন। এ সময় জহির আব্বাসের কাছে পরীক্ষামূলকভাবে গাড়িটি চালিয়ে দেখতে চান তারা। ক্রেতার চাওয়া অনুযায়ী গাড়িটি চালিয়ে পরীক্ষা করে নিতে রাজি হন জহির। রাত ১০টার দিকে জহিরকে নিয়ে ডিওএইচএস পার্ক থেকে টেস্ট ড্রাইভের নাম করে শেরেবাংলা নগর থানাধীন গণভবনের সামনে এসে গাড়ি থামায় ক্রেতা চক্রের দুই সদস্য। তাদের একজন পল্লবীর বাসিন্দা ভাইসতা রাসেল বলে পরিচয় দিলেও সহযোগীর নাম জানা যায়নি। একপর্যায়ে জহিরকে গাড়ি থেকে নেমে পেছনের সিটে বসার অনুরোধ করে তারা। সরল বিশ্বাসে জহির গাড়ি থেকে নামতেই দরজা বন্ধ করে গাড়িটি নিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে ২ যুবক। এ বিষয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়ার দুদিন পার হলেও গাড়িটি উদ্ধার বা চোরচক্রের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
এ অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা কাফরুল থানার এসআই আব্দুল হানিফ সরদার বলেন, তদন্ত চলছে। যার মাধ্যমে কথা হয়ে গাড়িটি ছিনতাই হয়েছে, তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তিনি ফেনীতে আছেন। ঘটনাস্থল ও আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও গাড়িটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।এর আগে গত ৮ মার্চ রাতে শাহবাগ মেট্রো স্টেশনের নিচ থেকে গাড়ি আমদানি ও বিক্রির ব্যবসায়ী মাশরুর নাঈরের আনুমানিক ৮৫ লাখ টাকা মূল্যের টয়োটা হেরিয়ার (হাইব্রিড) ব্র্যান্ডের একটি গাড়ি ছিনতাই করে চোরচক্র। সেদিন মাশরুরের প্রতিষ্ঠান হুইল ডিলস থেকে একটি জিপ গাড়ি কেনার জন্য যোগাযোগ করেন এক যুবক। পরে গাড়ি দেখতে এসে টেস্ট ড্রাইভের নামে গাড়িটি চালিয়ে দেখতে চান তিনি। ক্রেতার চাওয়া অনুযায়ী গাড়িটি তাকে চালাতে দেন মাশরুর। চক্রের এক সদস্য গাড়িটির চালকের আসনে বসেন। এ সময় নাঈরের চাচাতো ভাই পিয়াল মাহমুদও গাড়িতে ওঠেন। তারা পরীবাগ মোড়ে গেলে গাড়ি কিনতে আসা যুবকের সহকর্মী পরিচয়ে আরও দুই যুবক গাড়িতে ওঠেন। কিছুক্ষণ পর পিয়ালের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে তাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটি নিয়ে চম্পট দেয় ছিনতাইকারী চক্র। পরে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল নিয়ে তাদের পিছু করে তেজগাঁওয়ের একটি পেট্রোলপাম্পে গাড়িটির দেখা পান পিয়াল। বিষয়টি সেখানে উপস্থিত ৫ পুলিশ সদস্যকে জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এর ঘণ্টাখানেক পর মাশরুর নাঈরের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এ ঘটনায় মামলা না করতে এবং সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট না দিতে কয়েকটি বার্তা পাঠায় ছিনতাইকারীরা। আরেক বার্তায় ছিনতাইকারী লেখে, ভাই, গাড়ি পেয়ে যাবেন। এ জন্য ৭ দিন সময় লাগবে। গাড়ি ফেরত দিতে বললে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজে তারা বলে, লেটস প্লে ।
অন্য ঘটনায় বনানীর বাসিন্দা জাহিদ হাসান তার নামে নিবন্ধন করা এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা দামের টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার এসইউভি গাড়ি বিক্রির জন্য টিপু সুলতান নামে একজনকে দায়িত্ব দেন। বিক্রির আগে গাড়িটি মেরামতের জন্য একটি গ্যারেজে দেন টিপু সুলতান। এ সময় গ্যারেজের ম্যানেজারের মাধ্যমে চোরচক্রের সদস্য মাহাদী হাসান গাড়িটি কিনতে আসেন। একাধিকবার দেখার পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিকালে গাড়িটি চালিয়ে দেখবেন এবং মাকে দেখাবেন বলে টিপু সুলতানকে গাড়িতে উঠিয়ে গুলশান লেকপাড়ের বিলকিস টাওয়ারের সামনে যান। সেখান থেকে আরও তিনজন গাড়িতে ওঠেন। এরপর তারা টিপু সুলতানকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যান। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন মাহাদী হাসান। তিনি ও তার সহযোগী সবাই গাড়ি চোরচক্রের সদস্য। তারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কৌশলে গাড়ি চুরি করে আসছে বলে পুলিশের ভাষ্য।জানা গেছে, শুধু গাড়িই নয়, টেস্ট ড্রাইভের কথা বলে বাইক নিয়ে চম্পট দেওয়া চক্রও এখন রাজধানীতে সক্রিয়। দামি মোটরসাইকেল টার্গেট করে অনলাইনে বিচরণ তাদের। দামি বাইক বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখলেই কৌশলী হয়ে ওঠে তারা। কেনার কথা বলে টেস্ট ড্রাইভের নামে মোটরসাইকেল গায়েব করে দেয় তারা।
এ বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করে বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আব্দুল হক ও সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সম্প্রতি জানানো হয়, একটি প্রতারক চক্র চক্রাকারে টেস্ট ড্রাইভ বা ব্যবসায়িক প্রতিনিধি পরিচয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। চক্রটি গুলশান, তেজগাঁও, বারিধারা এবং অন্যান্য স্থানে সক্রিয়। সম্প্রতি এ ধরনের একটি প্রতারণার ঘটনা ঘটে বারভিডার সদস্য প্রতিষ্ঠান জেলার মোটরস (সদস্য নম্বর ১১৫) এবং ইউনিভিল (সদস্য নম্বর ১৯১)-এর সঙ্গে। প্রতিষ্ঠান দুটির গ্যারেজ থেকে টেস্ট ড্রাইভের নামে প্রতারকরা গাড়ি নিয়ে যায়, যা পরে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে বারভিডা তাদের সব সদস্যকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছে এবং দায়িত্বশীলভাবে গাড়ি প্রদানের আহ্বান করছে।