ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে রাতে ঋণের টাকা তুলে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী হায়দার রতন। সম্প্রতি একটি ভুয়া কোম্পানির অনুকূলে ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছে এবি ব্যাংক, যার সুবিধাভোগী সেই ব্যবসায়ী রতন। জালিয়াতির এই ঋণের তথ্য জানতে পেরে এরই মধ্যে তা আটকে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদের ব্যাখ্যাও চাওয়া হয়েছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলী হায়দার রতনের নামে পাঁচ ব্যাংকে বর্তমানে ৫৫৯ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি কাজের কার্যাদেশের বিপরীতে সন্দেহজনক উপায়ে নেওয়া এসব ঋণ এখন খেলাপি।বিএফআইইউর পরিদর্শনে উঠে এসেছে, ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিংয়ের নামে একটি নামসর্বস্ব কোম্পানির নামে ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ সম্প্রতি অনুমোদন করে এবি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। গত ১০ জানুয়ারি ব্যাংকটির গুলশান শাখায় ঋণের আবেদন আসে। আবেদনে প্রতিষ্ঠানটির মালিক দেখানো হয় মোহাম্মদ আতাউর রহমান ও মো. মামুন রশিদকে। তবে এর ঠিকানা দেওয়া হয়েছে রতনের মালিকানাধীন ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের, যার কার্যালয় ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে। আর আবেদনপত্রের প্যাডে যে ই-মেইল ও ওয়েবসাইট ব্যবহার করা হয়েছে তা-ও তারই মালিকানার ব্র্যান্ডউইন নামে আরেকটি কোম্পানির। এ কোম্পানির নামে দ্রুত ছাড় করতে আবেদনের দিনই এবি ব্যাংকের গুলশান শাখা ব্যবস্থাপকসহ তিন কর্মকর্তা গ্রাহকের ধানমন্ডির অফিস ও বাড়ির ঠিকানা পরিদর্শন করে একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন দেন। গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের নামে কখনও কোনো আমদানি না হলেও ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহক প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি, নির্মাণসামগ্রী, রাসায়নিক পদার্থ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানি করেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আমদানি তো দূরে থাক, কোম্পানিটির নিবন্ধন নেওয়া হয় গত জুনে। এর পর গত নভেম্বরে ১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে এবি ব্যাংকের গুলশান শাখায় একটি হিসাব খোলা হয়। এর বাইরে কোনো লেনদেনও নেই। অথচ ভুয়া পরিদর্শন প্রতিবেদন দিয়ে একেবারে নতুন নিবন্ধিত কোম্পানিকে বড় কোম্পানি দেখানো হয়। পরদিন ঋণপ্রস্তাবটি শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটিতে পাঠানো হয়। আবেদনের এক মাস পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের ৭৫৫তম পর্ষদ সভায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের জোর চেষ্টায় তা অনুমোদন হয়। আবার ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিংয়ের নামে ঋণ অনুমোদন হলেও সব ধরনের ব্যাংকিং রীতিনীতি অমান্য করে ইনফ্রাটেকের অনুকূলে ১৬ কোটি ১৩ লাখ টাকার গ্যারান্টি ইস্যু করে ব্যাংক। এবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজাল সমকালকে বলেন, ব্র্যান্ডশেয়ার ট্রেডিং আলী হায়দার রতনের কোনো বেনামি কোম্পানি নয়; বরং রতনের মালিকানার ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে ব্র্যান্ডশেয়ারের কনসোর্টিয়াম রয়েছে। যে কারণে ব্র্যান্ডশেয়ারের নামে ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন হলেও ইনফ্রাটেকের নামে ১৬ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করে ব্যাংক। বিষয়টি নিয়ে বিএফআইইউ আপত্তি জানানোর পরই ব্র্যান্ডশেয়ারের ঋণ ছাড় বন্ধ রেখে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। এ ছাড়া ইনফ্রাটেকের নামে যে ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করা হয়েছে, শিগগিরই তা কলব্যাক তথা ফেরত আনা হবে। তিনি বলেন, কোনো জায়গা থেকে সুবিধা নিয়ে কিছু করার ব্যক্তি তিনি নন। ব্যাংকটি একসময় বিএনপি নেতার মালিকানাধীন ছিল। সরকারের পক্ষ হয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে গিয়ে তাঁর অনেক শত্রু তৈরি হয়েছে। তাদের কেউ তাঁর নামে বদনাম ছড়াতে পারে।
জানা গেছে, বেনামি কোম্পানির নামে ঋণ অনুমোদন বিষয়ে প্রথমে গত ২০ মার্চ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে বিভিন্ন তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় বিএফআইইউ। এ ছাড়া পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ঋণ ছাড় বন্ধ রাখতে বলা হয়। পরে গত ২৫ এপ্রিল বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থাপন করে পর্ষদের পর্যবেক্ষণ, মতামত ও এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানানোর জন্য এমডিকে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়। যদিও গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই জানাননি ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ রকম বাস্তবতায় ১৮ মে এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক বরাবর পরিদর্শন প্রতিবেদনসহ একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে।জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে পাঁচ ব্যাংক থেকে নেওয়া রতনের ঋণের বেশিরভাগই এখন খেলাপি। যে কোনো খেলাপিকে নতুন করে ঋণ দিতে পারে না ব্যাংক। যে কারণে ভিন্ন কৌশলে আলী হায়দার রতনকে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করে এবি ব্যাংক। আগের সব ঋণই নেওয়া হয় সরকারি রাস্তার কার্যাদেশের বিপরীতে। সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে নেওয়া ঋণ সরাসরি ব্যাংকের হিসাবে জমা হয়। সেখান থেকে ব্যাংক টাকা কেটে লাভের অংশ গ্রাহককে পরিশোধ করে। তবে ন্যাশনাল, ইউসিবিএল, এসআইবিএল, জনতা ও বেসিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ৬০৯ কোটি টাকার কোনো বিল সরাসরি ব্যাংক হিসাবে জমা হয়নি। ফলে এসব ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া আদৌ কার্যাদেশ পেয়েছেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংকগুলোতে। যদিও এ নিয়ে কেউ কিছু বলতে রাজি হননি।
ন্যাশনাল ব্যাংকে ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের ঋণের পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত ২৮ ডিসেম্বর রাত ৮টা ২৩ মিনিট থেকে ৯টা ৪ মিনিটের মধ্যে পাঁচটি লেনদেনের বিপরীতে গুলশান শাখা থেকে তোলা হয় ২২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর আগের দিন ব্যাংকটি নিয়োগ দেওয়া সমন্বয়কের আপত্তি না মেনে ঋণ ছাড় করে। ব্যাংকিং রীতিনীতি এবং নির্দেশনা অমান্য করে ঋণ বিতরণের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।