বছরের শুরুতে ছিল উন্নয়ন কার্যক্রম উদ্বোধনের মৌসুম। উন্নয়ন দেখিয়েই নির্বাচনে দাপট দেখানোর অভিপ্রায় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া ৭৫ বছরের অভিজ্ঞ দল আওয়ামী লীগের। বিএনপি, জামায়াত, বামজোট, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অনেক দল ও জোটকে বাইরে রেখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে দলটি। এর আগের দুটি নির্বাচনের মতোই চরম বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এতে জাতীয় রাজনীতিতে অমোচনীয় ক্ষত এবং এর থেকে জনক্ষোভ তৈরি হলেও তা চাপা দিয়েই বলা যায় অনেকটা সামলে উঠেছিল দলটি। তবে বছরের শেষ দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বের কাছে ভুল চালে পরাস্ত হয় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলটি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। অন্যদিকে বৈধ ও অবৈধ পথ ব্যবহার করে দেশত্যাগ করেন বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা।এদিকে নেতৃত্বহীন অবস্থায় দেশে থাকা কর্মীরা পড়েন মহাবিপর্যয়ে। হামলা, মামলা, কারাভোগসহ যারপরনাই বিপদে পড়েছেন। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পরই ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ কয়েকটি কার্যালয় পড়ে ক্ষোভের আগুনে। দেশের বহু জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, দোকানপাটে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়।বেশির ভাগ নেতা এখনও আলোচনার আড়ালে; চলে গেছেন আত্মগোপনে। গুটিকয়েক নেতা-মন্ত্রী গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছেন, সময় সময় দিচ্ছেন বিবৃতিও। এসব দলে প্রাণসঞ্চারের জন্য যথেষ্ট নয়। এমন বাস্তবতাকে সংশ্লিষ্টরা দলটির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলে মনে করছেন। তাদের ভাষ্য- আওয়ামী লীগ দেশের পুরনো ও অভিজ্ঞ দল। দেশের রাজনীতিতে দলটি ফিরবেই। এর জন্য দরকার দলীয় সংস্কার ও পরিশুদ্ধ রাজনীতি। বর্তমান নেতৃত্বকে দেশের মানুষ তো দূরের কথা, দলের অনেক নেতাকর্মীই মেনে নেবেন না।
গত ৫ আগস্ট পতনের আগে অর্থাৎ ৪৯ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ বিপর্যয়ে মধ্যে পড়ে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। তবে আওয়ামী লীগ তছনছ হয়ে যায়। দলেও ভাঙন দেখা দেয়। প্রশ্ন উঠেছিল- আদর্শের উত্তরাধিকার নাকি রক্তের উত্তরাধিকার দলের নেতৃত্বে আসবে। এমন বাস্তবতায় ১৯৮১ সালের ১৭ মার্চ দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। দেশব্যাপী দল পুনর্গঠনে কাজ করেন।পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে অর্থাৎ দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আওয়ামী লীগ। এরপর ৪৩ বছর ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই চলছে দলটি। ২০০১-২০০৬ ক্ষমতার বাইরে থাকলেও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন দলের নেতাকর্মীরা। এরপর আসে ১/১১। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দেশের প্রধান এই দুই দলের নেতাকর্মীই পড়েন সংকটে। দুই নেত্রীকে কারাগারে যেতে হয়। আওয়ামী লীগের অনেক কর্মীকে কারাবরণ করতে হয়। তবে তারা হাল ছাড়েননি। এ অবস্থায় ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে দলটি। এরপর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে।গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়। ১৯৭৫-পরবর্তী অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগ শিক্ষা নেয়নি বলেই ২০২৪ সালে বড় সংকট দেখা দিয়েছে এমনটি মনে করেন দলটির জেলা পর্যায়ের এক নেতা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের নির্বাসন দলীয় রাজনীতির সঙ্গে মানানসই নয়। আদর্শ ও দায়বদ্ধতা থাকলে কোনো পরিস্থিতিতেই ভয় কাজ করে না। ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে যারা রাজনীতি করতে পারবেন, তাদেরই আওয়ামী লীগের রাজনীতির নেতৃত্বে আসা উচিত। তবে এই নেতা জানেন না, কবে এই পথে ফিরবে দলটি।
দলের সাবেক এক কেন্দ্রীয় নেতার ভাষ্য- স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের বিকল্প দলে ছিল না। এরপর ১৯৭৫ সালে রক্তাক্ত পটপরিবর্তনে স্বভাবতই ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে দলটি। এ অবস্থায় দলে ভাঙন দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের পর এসে দল অনেকটা একতাবদ্ধ হয়ে যায়। সেই সময়ে কিছু নেতা আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছেড়ে অন্য দলে চলে যান। কেউ কেউ রাজনৈতিক দলও গড়েন। ১৯৮১ সাল থেকে আজ অবধি দলে বিকল্প তৈরি না হওয়ায় শেখ হাসিনার অনুপস্থিতি দলে ফের সংকট তৈরি করবে। শুধু তাই নয়, দলে সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনা একা নেওয়ার পরিণতিই ৫ আগস্ট ডেকে এনেছে বলে মনে করেন এই নেতা।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এক প্রতিরোধ যোদ্ধা জানান, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জীবনবাজি রেখে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন কিছু শেখ মুজিব-পাগল মানুষ। কিন্তু ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তাদের মূল্যায়ন তো করেইনি, বরং অনেকে উপহাসের শিকার হয়েছেন। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দলের ত্যাগী নেতাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। অভিজ্ঞ নেতারা অনেক সময় অন্তরালে থেকে গেছেন। ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অনেক নেতাকর্মী মাঠে নামেননি।শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও সিলেটে প্রতিক্রিয়া হলেও পরবর্তী সময়ে তা থেমে যায়। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করায় তারা প্রকাশ্যে আসতে পারছে না। অবশ্য যুবলীগ দিবসভিত্তিক কর্মসূচিতে বিচ্ছিন্নভাবে লুকিয়ে অংশ নেয়। বর্তমানে রাত-বিরাতে জয় বাংলা স্লোগান দেয়ালে, পোস্টারে লিখে বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করছে। অন্যদিকে দেশের বাইরে দলের শাখাগুলো থেকে সভা-সেমিনার ও বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। কিছু অনুষ্ঠানে ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি অংশ নিচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে তিনি কথা বলছেন এমন অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভারতে থাকলেও দলের বিষয়ে কোনো কথা বলছেন না। কারও সঙ্গে সাক্ষাতও করছেন না। ভারতে অবস্থান করেও শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সব রকম চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে তার। এমন বাস্তবতায় দল তাকে বয়কট করেছে নাকি তিনি দলের বিশ্বাস হারিয়েছেন এই প্রশ্ন সবার মুখে মুখে।গোপনে দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে যুক্ত এমন একজন নেতা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সুদিন এলে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছানির্বাসিত নেতারাই ফের দলের সামনে থাকবে। বঞ্চনার শিকার হবেন নির্যাতিতরা। তিনি জানান, এই সত্য এবং অনিশ্চিত গন্তব্য জেনেই দলের জন্য লড়ে যাচ্ছেন এবং লড়ে যাবেন।এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ বেশ কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছে। ৫ বছরের জন্য তারা এসেছিল। এর বিপরীতে দলের ভেতরে বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি হয়েছে তা দলের নেতৃত্ব দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। গণমাধ্যমের রেফারেন্স তুলে ধরে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা দেশ ও দলে গণতন্ত্রহীনতা, গুম, খুন করে মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছেন। এ ছাড়া নির্যাতনের প্রতীকী রূপ আয়নাঘরসহ যুবলীগ-ছাত্রলীগের অপরাজনীতি দেশকে বৈষম্যে চরমে পৌঁছায়। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরায় অনিশ্চয়তা, অন্য সব রাজনৈতিক দলকে দমন-পীড়নেই আওয়ামী লীগের এই করুণ পরিণতি হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাসঙ্গিকক্রমে বলা যায়, দেশের কোনো দলই গণতন্ত্রের চর্চায় নেই। মানুষের মঙ্গল কামনায় রাজনীতির আপ্তবাক্য হয়ে পড়ে সুদূরপরাহত।আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, এটা হবে বলার আগে দলের মধ্য থেকে আহ্বান আসতে হবে। কারণ দলটি বর্তমানে তাদের রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং দলে বড় রকমের পরিবর্তন না এলে এর স্বাভাবিক ফেরা কঠিন হবে। খুব কাছাকাছি সময়ে আওয়ামী লীগের ফেরার সম্ভাবনাও দেখছেন না তিনি।