আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক আজ সর্বজনীন পেনশনের নিবন্ধন এক লাখ ছাড়াল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্কুল-মাদরাসা বন্ধ রাখতে হাইকোর্টের নির্দেশমহাবিপদ এড়াতে এখনই সাজাতে হবে পরিকল্পনা ২৭ জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা বন্ধ থাকবে আজ
No icon

অনলাইন ক্লাসে শিক্ষকদের অনীহা কেন?

বর্তমান করোনার মহামারির সংকটের সময়ে ইউরোপ ও আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অনলাইনে বর্তমান শিক্ষাবর্ষের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করেছে। এমনকি কনভোকেশন বা শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানও অনলাইনে হয়েছে। কিন্তু এর উল্টো চিত্র বাংলাদেশে। এ দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাসের পর মাস বন্ধ রয়েছে। যদিও ডিজিটাল বাংলাদেশের ইন্টারনেটের সুবিধা ব্যবহার করে খুব সহজেই ইউরোপ-আমেরিকার মতো শিক্ষা কার্যক্রম চলানো যেত। অবশ্যই সর্বশেষ শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ইউজিসিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার অনুরোধ করেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনলাইনে ক্লাস চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে।যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে নজর রাখলে দেখা যাবে যে কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস বর্জনের জন্য নানা তৎপরতা চালাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি হচ্ছে ১. বেশির ভাগ শিক্ষার্থী গ্রামে থাকায় ইন্টারনেটের সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে অনলাইন ক্লাস করা তাদের জন্য সম্ভব হবে না। ২. সব শিক্ষার্থীর ইন্টারনেটে ক্লাস করার জন্য যে ডাটা ব্যবহার করার দরকার তা কেনার মতো আর্থিক সামর্থ্য তাদের নেই। ৩. অনেকেই নানা সংকটে থাকায় অনলাইনে ক্লাস করায় তাদের জন্য নতুন মানসিক বিড়ম্বনা তৈরি করবে। ৪. তারা অনলাইন ক্লাসে কোনো কারণে অংশগ্রহণ করতে না পারলে অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে তারা পিছিয়ে পড়বে। শিক্ষার্থীদের এসব যুক্তি কিছু শিক্ষার্থীর জন্য সত্য হলেও সব শিক্ষার্থীর জন্য সত্য নয়। কারণ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে। কিছু কিছু এলাকায় ইন্টারনেটের গতি কম হলেও তা ক্লাস কনটেন্ট ডাউনলোড করার মতো যথেষ্ট। আর্থিক সংকটের বিষয়টি অবশ্যই আমলযোগ্য, তবে তা-ও কিছু শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে অনলাইনে ক্লাস শুরু করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ওই ক্লাসে অংশগ্রহণে সমস্যায় পড়বে। বাকি ৯০ শতাংশ সহজে ওই ক্লাসে যুক্ত হতে পারবে। অনেকের আশঙ্কা, এর মাধ্যমে বৈষম্য তৈরি করবে। আমরাও চাই শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো বৈষম্য তৈরি না হোক এবং সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তবে যে যুক্তিতে অনলাইন ক্লাস বৈষম্য তৈরি করবে বলে দাবি করা হচ্ছে, তা ঠুনকো যুক্তি বলে মনে হয়।

অনলাইন ক্লাসে কোনো বৈষম্যের আশঙ্কা থাকলে তা দূর করা যাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অনুসরণ করলে। জবির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অনলাইনের প্রতিটি ক্লাস রেকর্ড করে শিক্ষক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক বা ইউটিউবে আপলোড করবেন। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন সপ্তাহ রিফ্রেশমেন্ট ক্লাস নিয়ে পরীক্ষার আয়োজন করা হবে। এ ক্ষেত্রে হয়তো প্রথম ও দ্বিতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষা একত্রে নিতে হতে পারে। কিন্তু এর ফলে শিক্ষার্থীরা খুব সহজে একটি বছর সেশনজট থেকে রক্ষা পাবে। পড়ালেখায় যুক্ত থাকার মাধ্যমে করোনাকালীন মানসিক ট্রমা থেকে মুক্ত থাকবে। আর ক্লাস রেকর্ডিং থাকায় কোনো কারণে শিক্ষার্থীরা সরাসরি ক্লাসে অংশগ্রহণ না করতে পারলেও পরবর্তী সময়ে ক্লাস লেকচার থেকে সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। এমনকি গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পরও তারা ক্লাস লেকচার তাদের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে পারবে। করোনা সংকটের সময় দেখেছি, শিক্ষার্থীরা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে আর্থিক সহায়তা করেছে। ইন্টারনেট ক্রয়ের আর্থিক সমস্যা সমাধানে সামর্থ্যবানরা অন্যদের সহায়তা করতে পারে। সরকারকেও অবশ্যই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কম মূল্যে ইন্টারনেট ও কল সুবিধা প্রদানের জন্য গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তি করেছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ফোন কম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা প্রদানের সুযোগ করে দিতে পারে।অনলাইন ক্লাসে শিক্ষককে প্রশ্ন করা যাবে না বলে অনেকে অজুহাত তুলছেন। কিন্তু জুম বা অন্য যেকোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেই প্রশ্ন করার সুযোগ আছে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে মেইল বা ফোনে প্রশ্ন করে উত্তর জেনে নিতে পারবে। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রশ্ন পরবর্তী ক্লাসের শুরুতে শিক্ষক আলোচনা করলে সব শিক্ষার্থী বিষয়টা জানতে পারবে। আর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অফলাইন ক্লাসেও যে শিক্ষার্থীরা খুব একটা প্রশ্ন করার সুযোগ পায় এমন নয়। বেশির ভাগ শিক্ষকের ক্লাসে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ থাকে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে প্রশ্ন করা পছন্দ করেন এমন শিক্ষকের সংখ্যা হাতে গোনা। তাই প্রশ্ন করার প্রশ্ন তোলা খোঁড়া যুক্তি।

অনলাইন ক্লাসের বিরোধিতার মূল কারণ অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা মনে করছে ক্লাস না হলে স্যারদের বলেকয়ে একটা সাজেশন বের করে অল্প পড়ে সেমিস্টার শেষ করা যাবে। অন্যদিকে শিক্ষকদের মধ্যে অনেকের বিরোধিতার কারণ অনলাইন ক্লাসে অনভ্যস্ততা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক অনলাইন ক্লাসের বিরোধিতায় সরব এবং অনলাইন ক্লাসে অংশ না নিতে শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের রেকর্ড ঘাটলে দেখা যাবে যে অফলাইনেও তাঁরা কখনো নিয়মিত ক্লাস নেননি। পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের কিছু প্রশ্ন বলে দিয়ে এবং মিডটার্ম ও ফাইনাল পরীক্ষায় ঢালাওভাবে নম্বর প্রদান করে শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে দায়িত্ব শেষ করেছেন। অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ ও রেকর্ড করে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে আডলোডের বিষয় তাই তাদের চিন্তায় ফেলেছে। যথাযথ প্রস্তুতি থাকলে কোনো শিক্ষকের অনলাইনে ক্লাস নিতে এবং তা রেকর্ড করে আপলোড করতে অনীহা থাকার কথা নয়। কারণ শিক্ষকদের কাজ শুধু ক্লাসে পড়ানো নয়। পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে তাঁদের মত ও চিন্তা জনসমক্ষে তুলে ধরা। তাই অনলাইন ক্লাসের রেকর্ড জনসম্মুখে প্রকাশ তাঁদের দায়িত্বেরই অংশ। এর মাধ্যমে অবশ্যই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে। শিক্ষকরা আসলে কতটুকু মানসম্মত পাঠদান করেন, তা জনসম্মুখে প্রকাশিত হবে। আর যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া অনলাইনে ক্লাসে আসা শিক্ষকদের পক্ষে সম্ভব হবে না বলে শিক্ষার্থীরাই উপকৃত হবে।অবশ্যই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে বড় বাধা। প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে, শিক্ষকরা চিন্তা ও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীন। কিন্তু সম্প্রতি ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য অনেক শিক্ষককে জেলে যেতে হয়েছে। শিক্ষকরা মুক্তভাবে তাঁদের চিন্তা ও মত প্রকাশ করতে পারলে অনলাইন ক্লাস চতুর্থ শিল্পবিল্পবের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শুধু করোনাকালে নয়, প্রযুক্তির ব্যবহার যাতে সব ক্লান্তিকালে কাজে লাগানো যায় তা নিশ্চিত করতে স্বাভাবিক সময়েও প্রতি সেমিস্টারে কমপক্ষে একটি কোর্স অনলাইনে নেওয়া এবং তা রেকর্ড করার ব্যবস্থা করে ফেসবুক বা ইউটিউবে আডলোডের নিয়ম চালু করা দরকার। তাতে শিক্ষার্থীরা যেমন উপকৃত হতে পারবে, তেমনি শিক্ষকরা নিজেদের আয়নায় নিজেদের বিচার করতে পারবেন। অফলাইন ক্লাসে প্রস্তুতিবিহীন সাংসারিক আলাপ বা নিজের গুণর্কীতন বর্ণনা করে সময় পার করার প্রবণতা কমবে। শিক্ষকরা যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে হলেও ওই একটি ক্লাসে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করবেন, যা অন্য ক্লাসে মনোযোগী হতে তাঁদের আগ্রহী করে তুলবে। নতুন নতুন চিন্তার বিকাশ হবে। তাই গত্বাঁধা শিক্ষাক্রম থেকে উচ্চশিক্ষাসহ সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রমকে বের করে আনার জন্য অনলাইন ক্লাসের আয়োজন এবং ওই ক্লাস রেকর্ড করে ফেসবুক বা ইউটিউবে আপলোড করার ব্যবস্থা সব সময় চালু রাখা জরুরি বলে মনে করি।