দেশের টেলিকম খাত আবারও বিদেশি স্বার্থের কবলে পড়তে চলেছে- এমন আশঙ্কায় যারপরনাই উদ্বিগ্ন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) টেলিকম নেটওয়ার্কিং ও লাইসেন্সিং নীতিমালা ২০২৫ -এর খসড়ায় এমন কিছু প্রস্তাব রয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় আইএসপি, আইআইজি, এনটিটিসহ গোটা টেলিযোগাযোগ খাতের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। তাদের অভিযোগ- সরকার প্রস্তাবিত এ নীতিমালা দেশের স্বার্থে নয় বরং বিদেশি করপোরেট স্বার্থ রক্ষার জন্য বানানো হয়েছে। এই নীতিমালা বর্তমান রূপে অনুমোদন পেলে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। এমনকি অস্তিত্ব রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়বে।গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের (টিআরএনবি) মতবিনিময় সভায় এমন আশঙ্কার বিষয়টি তুলে ধরেন টেলিযোগাযোগ খাতের দেশীয় উদ্যোক্তারা। সভায় সভাপতিত্ব করেন টিআরএনবির সাবেক সভাপতি ও ভিউজ বাংলাদেশের সম্পাদক রাশেদ মেহেদী। স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন।
বিদেশিদের জন্য সুবিধা, দেশীয়দের জন্য সংকট
আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, বিটিআরসিকে আমরা বারবার সতর্ক করেছি, নীতির নামে যেন দেশীয় উদ্যোক্তাদের ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া না হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বিদেশি ৩টি অপারেটরকে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়েই গাইডলাইন চূড়ান্ত করা হচ্ছে। তার মতে, নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে প্রান্তিক পর্যায়ের ইন্টারনেট খরচ কমপক্ষে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং লাখো মানুষের কর্মসংস্থান পড়বে হুমকিতে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, যদি দেশীয় উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা ছাড়া কোনো নীতিমালার অনুমোদন হয়, তবে আমরা আদালতের শরণাপন্ন হব।
নীতিমালায় ফিরে আসছে একাধিপত্য
সামিট কমিউনিকেশনের সিটিও কে এম তারিকুজ্জামান বলেন, ২০০৮ সালের আইএলডিটিএস নীতিমালায় যে মনোপলি (্একাধিপত্য বা একচেটিয়া অধিকার) ভাঙা গিয়েছিল, নতুন গাইডলাইনে আবার সেই পুরনো দশায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।ফাইবার অ্যাট হোমের নির্বাহী পরিচালক সুমন আহমেদ সাবির বলেন, সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা একতরফা স্বার্থে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের দেশগুলো যেখানে দেশীয় উদ্যোক্তা সুরক্ষায় কাজ করছে, আমরা সেখানে হাঁটছি উল্টোপথে।মতবিনিময় সভায় প্রযুক্তি নীতিমালা বিশ্লেষক আবু নাজম মুহাম্মাদ তানভীর হোসেন বলেন, ২০০৮ সালের পর এত কম সময়ে এত বেশি ড্রাফট আসা নজিরবিহীন। ৩৩ নম্বর ধারায় পাঁচ মন্ত্রীর কমিটির মাধ্যমে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ লাইসেন্স নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এতে বিটিআরসি হয়ে যাবে কেবল নথি প্রক্রিয়াজাতকারী সংস্থা। তিনি প্রশ্ন তোলেন, টেলিকমের কোন লাইসেন্সটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নয়? সেন্ট্রাল ল ফুল ইন্টারসেপশন প্ল্যাটফর্ম বা সিএলআইপিনামে নতুন সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তাও অস্পষ্ট বলে মনে করেন তিনি।
লাভজনক খাত তুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশিদের হাতে!
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল সরকারের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এ সরকার নিজের মতোই যা কিছু করছে, কারও কথা শুনছে না। দেশের লাভজনক খাতগুলো বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছে।
অসম প্রতিযোগিতা
আইএসপিএবি সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া প্রশ্ন রাখেন, ইন্টারনেট কি পৃথক কোনো পণ্য? মোবাইল, স্যাটেলাইট, ফাইবার- সবই তো ইন্টারনেটের অংশ। তবু নীতিতে এমন বিভাজন কেন? তিনি দাবি করেন, বিদেশি অপারেটরদের ক্রসকাটিং সুবিধা দিয়ে আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অসম প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
ঐক্যের ডাক
আইজি অপারেটরস ফোরামের নেতা মুশফিক মনজুর বলেন, এরশাদ সরকারের সময়ের ওষুধ নীতির মতো যদি দেশীয় স্বার্থ রক্ষায় সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া হতো, তা হলে আজ আমরা বিশ্বমানের ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারতাম। তিনি আরও বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের মূল অঙ্গীকার ছিল বৈষম্য দূর করা- কিন্তু নতুন নীতিতে সেই বৈষম্যই গভীর হচ্ছে।