জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করেছে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন। অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করায় জুলাই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তপশিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে। সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। জুলাই অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে। পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় বলা হয়েছিল, সংবিধান ও আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে জুলাই সনদ। আট দফা অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছিল, জুলাই সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বিএনপিসহ আটটি দল এতে একমত না হয়ে জানিয়েছিল, কোনো কিছুই সংবিধানের ওপর প্রাধান্য পেতে পারে না। আদালতের প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকলে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।বিএনপির এ অবস্থানের কারণে ঐকমত্য কমিশন চূড়ান্ত সনদে সংবিধানের ওপর প্রাধান্যের অঙ্গীকার বাদ দিয়েছে। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে ঐকমত্য কমিশনের সভায় চূড়ান্ত করা সনদে বলা হয়েছে, সই করা রাজনৈতিক দলগুলো সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তুলবে না। বরং সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
চূড়ান্ত সনদে বাস্তবায়ন পদ্ধতি রাখা হয়নি। সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে আজ বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোটের সঙ্গে সংলাপে বসবে কমিশন। সূত্র জানিয়েছে, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের যেসব পরামর্শ পাওয়া গেছে, তা দলগুলোকে জানানো হবে। তাদের মতামত সমন্বয় করে সংবিধান সংস্কারের একটি পদ্ধতি কমিশন সরকারকে সুপারিশ করবে। কমিশন সূত্র সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছে।গতকাল ঐকমত্য কমিশনের সভায় চূড়ান্ত করা সনদের পটভূমিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা খসড়ায় ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের নাম এড়াতে ছয় দফার আন্দোলনের বদলে ছেষট্টিকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জামায়াতের দাবি ছিল, সনদে ভাষা আন্দোলন, ২০০৬ সালের লগি-বৈঠার হত্যাকাণ্ডকে স্বীকৃতি দেওয়া। চূড়ান্ত সনদে ২০০৬ সালকে কিছু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৩ সালের শাপলা গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল ধর্মভিত্তিক দলগুলো। চূড়ান্ত সনদে একে নির্মম হত্যাযজ্ঞ বলা হয়েছে।
বাস্তবায়নের জট এখনও খোলেনি কমিশন সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তকে তিনটি ভাগ করেছে। ৩৪টি সংস্কার বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। ২১টি সংস্কার করা যাবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে। ৯টি সংস্কার করা যাবে নির্বাহী আদেশ। বাকি ২০টি সংস্কার অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন শুরু করেছে।যেসব সংস্কারের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই, সেগুলো অধ্যাদেশ বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নে বিএনপিসহ প্রায় সব দল একমত। বিএনপি মতামতে জানিয়েছে, সংবিধান সংশোধন করতে হবে এমন সংস্কার আগামী সংসদে গঠিত সরকার পরবর্তী দুই বছরে তা বাস্তবায়ন করবে। জামায়াতে ইসলামী এর বিরোধী। তারা নির্বাচনের আগেই সাংবিধানিক আদেশ এবং গণভোটের মাধ্যমে সাংবিধানিক সংস্কারের বাস্তবায়ন চায়। এ দলটির মতো এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল সনদের আইনি ভিত্তি এবং সনদের অধীনে নির্বাচন চায়।
দুই দফা বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা রাষ্ট্রপতির বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন ঐকমত্য কমিশনকে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গণভোটই সবচেয়ে টেকসই উপায়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে গণভোট আয়োজন দুরূহ, সময়সাপেক্ষ এবং ভোটে তা পাস হওয়া নিয়ে সংশয় থাকায় সাংবিধানিক আদেশই নিরাপদ উপায়। যদিও বিএনপির মত হলো, সংবিধানে এমন সুযোগ নেই।সূত্র জানিয়েছে, সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে আজকের সংলাপে ঐকমত্য কমিশন গণভোট, সাংবিধানিক আদেশ, অধ্যাদেশ এবং নির্বাহী আদেশ প্রস্তাব করবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। দলগুলো সাংবিধানিক সংস্কারে গণভোট বা সাংবিধানিক আদেশ যে পদ্ধতিতে একমত হবে, সেভাবেই সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে সুপারিশ করবে কমিশন। যদি ঐকমত্য না হয়, তবে কমিশন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সুপারিশ আকারে সরকারকে দেবে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সনদ চূড়ান্ত হয়েছে। তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর। বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে কমিশন শুধু সুপারিশ করবে সরকারকে। বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একদিনই বৈঠক হবে। সনদে আর কিছুই সংযোজন বিয়োজনের সুযোগ নেই।চূড়ান্ত সনদ হাতে না পাওয়ায় সনদকে সংবিধানের অংশ করার অঙ্গীকারনামার বিষয়ে মন্তব্য করেননি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি জানিয়েছেন, সংলাপে অংশ নেবে বিএনপি। বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, আইনি এবং সাংবিধানিকভাবে বৈধ পদ্ধতিতে সংস্কার বাস্তবায়নে প্রস্তাব এলে বিএনপি আলোচনায় অংশ নেবে। দলের অবস্থান হলো, আইনের বাইরে বিএনপি যেতে পারবে না।জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, নির্বাচনের আগেই পুরো সনদের বাস্তবায়ন চাই। সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তের যেগুলোতে জামায়াতের নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হোক। কারণ, জামায়াত আপত্তি করলেও সেগুলোতে অধিকাংশ দলের সম্মতি রয়েছে। সাংবিধানিক সংস্কারের সিদ্ধান্তগুলো প্রথমে সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে। এরপর তা গণভোটে দিতে হবে। যদি গণভোটে সংস্কার প্রস্তাব হেরে যায়, জামায়াত জনতার রায় মেনে নেবে। কমিশন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ এবং জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ ধারা অনুযায়ী সাংবিধানিক আদেশকে সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে সরকারকে সুপারিশ করতে পারে বলে সূত্রগুলো সমকালকে জানিয়েছে।