ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাবে এরই মধ্যে বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের দামে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে ইরানের হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণায় সেই প্রভাব দ্রুত বিশ^ব্যাপী ছড়াচ্ছে। আর বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য এটি আরও বেশি শঙ্কার। কারণ, দেশে এখনও জ্বালানি তেলের রিজার্ভ সক্ষমতা মাত্র ৪৫ দিনের। এ ছাড়া রয়েছে আর্থিক সংকট। ফলে দেশে জ্বালানি তেল সরবরাহে মূল্য বৃদ্ধিসহ জোগান নিশ্চিত করা কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।জানা গেছে, গতকাল সোমবার ব্রেন্ট ক্রড অয়েলের দাম ২ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৯ দশমিক ১২ ডলার আর যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের দাম ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৫ দশমিক ৯৮ ডলার। ইরান কৌশলগতভাবে হরমুজ প্রণালিতে জাহাজ চলাচলে বাধা দিলে ব্রেন্ট তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি কমপক্ষে ১০০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে বলে শঙ্কা করা হচ্ছে। দেশে জেট ফুয়েলের দাম এত দিন বিপিসি নির্ধারণ করে আসছিল। ২০২৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ফার্নেস অয়েল ও জেট এ-১ এর দাম নির্ধারণের এখতিয়ার বিইআরসির ওপর ন্যস্ত করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনের পর গত ২৩ মার্চ প্রথমবারের মতো জেট ফুয়েলের দাম নির্ধারণের গণশুনানি গ্রহণ করে বিইআরসি। আর ১৩ মে দাম ঘোষণা করে কমিশন। তখন বলা হয়েছিল, প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেছেন, জুন মাসের প্রথম দিকে লম্বা ছুটি থাকায় বিষয়টি পিছিয়ে যায়। আর এখন ইরান-ইসরায়েল সংকটের কারণে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ হরমুজ প্রণালি দিয়ে সৌদি ও আবুধাবি থেকে বছরে দুই ধরনের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে, যার পরিমাণ প্রায় ১৫ লাখ টন। ইরানের হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, জ্বালানি তেল আমদানিতে কী হতে পারে, এরই মধ্যে সে বিষয়ে সৌদি আরবকে জানানো হয়েছে। দেশটি থেকে এখনও কোনো উত্তর আসেনি।বিপিসি কর্মকর্তা বলেন, সৌদি থেকে ক্রুড অয়েল আমদানি করা যাবে কি না, এ বিষয়ে তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। তবে, এটা নিশ্চিত; যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলদেশ। প্রথমত তেলের জোগান নিরবচ্ছিন্ন রাখাই চ্যালেঞ্জ হবে। বাড়বে জ্বালানি তেলের দাম। পাশাপাশি জাহাজ ভাড়া, ইন্স্যুরেন্স, জাহাজ পাওয়া- সব কিছুই জটিলতার মধ্যে পড়বে।এ বিষয়ে কথা হয় বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসানের সঙ্গে। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আপাতত আমাদের জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহে কোনো প্রভাব পড়েনি। আশা করছি হয়তো এ যুদ্ধ দ্রুতই থেমে যাবে। তবে, যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হলে জ;ালানি তেলের সরবরাহ ও দাম বৃদ্ধি হবে। সব কিছুই নির্ভর করবে এ যুদ্ধের বিস্তৃতির ওপর।
এদিকে, দেশে প্রতি মাসে জেট ফুয়েলের (উড়োজাহাজের জ্বালানি) দাম সমন্বয়ের ঘোষণা থাকলেও এই জুনে সমন্বয় করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। হরমুজ প্রণালি নিয়েও টেনশন হচ্ছে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে জুলাইয়ে জেট ফুয়েলের দাম সমন্বয় করা হবে। হরমুজ প্রণালি সচল থাকলে একরকম, আর সংকট বেড়ে গেলে চিত্র বদলে যেতে পারে।হরমুজ প্রণালি বন্ধে ইরানের পার্লামেন্ট এরই মধ্যে অনুমোদন দিয়েছে। অন্যদিকে, গতকাল ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- রবিবার কোসউইজডম লেক ও সাউথ লয়্যালটি নামের দুটি খালি সুপার ট্যাংকার হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করলেও তারা আচমকা গন্তব্য বদলে ফেলে। দুটি জাহাজের প্রতিটিতে প্রায় ২০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে। চলমান উত্তেজনার মধ্যে জাহাজগুলোর ফিরে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যে বিকল্প রুটে চলাচল শুরুর প্রথম ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। চলমান সংকট, সরবরাহ ও পরিবহনব্যবস্থায় কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে; সে বিষয়ে জাহাজের মালিক ও ব্যবসায়ীরা সতর্কভাবে নজর রাখছেন বলে মনে করছে ব্লুমবার্গ।পারস্য সাগর ও ওমান সাগরের মধ্য সংযোগ তৈরি করেছে হরমুজ প্রণালি। জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুট হরমুজ প্রণালি ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ। বিশ্বের মোট জ্বালানির এক পঞ্চমাংশ এবং এলএনজির এক-তৃতীয়াংশ এই প্রণালি দিয়ে পরিবহন হয়ে থাকে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই জ্বালানি তেলের পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে।