১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের গত ৫৩ বছরের পথচলায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বছর ২০২৪ সাল। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিভিন্ন দলের নেতারা মনে করেন, ২০২৪ সালে দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে দেশ। এ বছরই ফের শুরু হয়েছে নতুন করে গণতন্ত্রের জয়যাত্রা। নতুন প্রজন্মের দেশপ্রেমের অনন্য নজির ২০২৪। নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখার বছরও এটি।১৭ বছরের গুম, খুন হত্যা নিপীড়ন নির্যাতনের অবসান ঘটিয়েছে ২০২৪ সাল। এই বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি তার মুক্ত ও স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় রুদ্ধ গণতন্ত্রের মুক্তির পরিবেশ ফিরে এসেছে। মুক্ত জীবনে ফিরে এসেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গত ১৭ বছরে দায়ের করা প্রতিহিংসামূলক মামলা ও সাজা আইনি প্রক্রিয়ায় বাতিল হচ্ছে। এখন যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরার অপেক্ষায় তিনি। দেশের বিভিন্ন কারাগারে যেসব রাজনীতিবিদ, ভিন্নমতাবলম্বী বন্দি ছিলেন তারাও আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত হচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে গুপ্তবন্দি কেউ কেউ মুক্ত হয়েছেন। বিএনপি ও তার মিত্র রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল ও জোট অবাধে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হতে পারছে। জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ছাত্ররা নির্বিঘে তাদের কর্মকা- চালাতে পারছেন।রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নেতারা মনে করেন, ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ধারার
রাজনীতি গতিপথ হারাতে শুরু করে। এরপর, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসীন হয় আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বিএনপি ও সমমনা দলসহ সরকারবিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ওয়ান ইলেভেন সরকার যে নির্যাতন করে আসছিল, সেই ধারা অব্যাহত রাখেন শেখ হাসিনাও। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র ও যোগসাজশে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে পরপর চারবার প্রধানমন্ত্রীর পদ আঁকড়ে ধরে রাখেন শেখ হাসিনা। ভিন্ন দল ও মতের মানুষের বিরুদ্ধে তিনি এমন নির্যাতন-নিপীড়ন চালান যে, তার বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিবাদ করারও অবকাশ ছিল না। কোনো দল বা ব্যক্তিকে ন্যূনতম হুমকি বলে মনে হলেই তার স্থান হতো কারাগারে। নয়তো চলতো গুম কিংবা বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-।সম্প্রতি গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৮৫৮ জন শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত সাড়ে ১১ হাজার মানুষ। এর মধ্যে সাধারণ ছাত্র, রাজনৈতিক দলের কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ রয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা, বিএনপি ও জামায়াতের তুলে ধরা তথ্যানুযায়ী, গত ১৫ বছরে ১৬ শতাধিক মানুষকে গুম করা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে শুধু বিএনপির ৬০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দেড় লাখ মামলা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিনকে গুম করে ভারতের শিলংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় মসজিদের খতিব এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সংস্থা- প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদেরও পালিয়ে যেতে হয়েছে। এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল।
জাতীয় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ২০২৪ সালকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। জুলাই পূর্ব ও জুলাই পরবর্তী। জুলাই পূর্বে ফ্যাসিস্টদের সম্পর্কে যা যা বলা যায়, সবই বলেছি। বিগত বছরগুলো নিয়ে দশ লাইনেই বলা যায়। কিন্তু জুলাই পরবর্তী শুধু ১০দিন নিয়ে দশ ঘণ্টায়ও ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি বলেন, এখন হচ্ছে পরিবর্তনের সময়। এ সময়ে মানুষের আশা অনেক বড়। সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে, দেশ বদল করা নিয়ে কথা হচ্ছে। দেশে বর্তমানে একটা সরকার আছে। এটা নতুনধর্মী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারা দেশজুড়ে এখনও নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তবে তাদের চেষ্টা চলছে। ২০২৪ সালকে বলা যায়, নতুন গণতন্ত্র শুরুর বছর।জুলাই বিপ্লব থেকে রাজনীতিবিদদের অনেক কিছু শেখার আছে বলে মনে করেন মান্না। তিনি বলেন, এই যে দেশ ও দেশের মানুষ বদলে যাচ্ছে- এগুলো ধরতে হবে। জুলাই বিপ্লবের যে স্পিরিট (মর্ম), সেটার সাথে মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু এখনও চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মামলাবাজি হচ্ছে। রাজনীতিবিদরা যদি জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটের সাথে থাকতাম, তাহলে এগুলো পুরোপুরি বন্ধ হতো।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় যেতে বা ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রতিটি নির্বাচনের আগে এবং ভোটের দিন ভিন্ন ভিন্ন কৌশল করতেন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে ওয়ান ইলেভেন সরকারের সাথে হাত মেলান, ভোটের দিন কলাকৌশল করে ফল নিজের পক্ষে নেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এই নির্বাচন বিএনপি ও তার মিত্রসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। ফলে নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীবিহীন। অর্ধেকেরও বেশি আসনে তাই ভোট ছাড়াই সংসদ সদস্য বনে যান আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলের প্রার্থীরা। দেশে বিদেশে এটি অবৈধ নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে কারাবন্দি করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও আগের রাতে ভোটের বাক্স ভর্তি করে ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এ নির্বাচন রাতের ভোট হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের নেতাদের কারাবন্দি করলে, অনেকটা ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ফের সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা।