অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার চার মাস পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সংকট উত্তরণে বেশকিছু ভালো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখনও সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন অটুট। তবে প্রশাসনসহ প্রায় সর্বত্র বিরাজ করছে অস্থিরতা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সমাধান একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হলেও সাধারণ মানুষ আছে অস্বস্তিতে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতা পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান বলে মনে করছেন বিভিন্ন দলের নেতারা। এ অবস্থায় সংস্কার ও নির্বাচনী রোডম্যাপ একই সঙ্গে সামনে থাকলে অস্বস্তি অনেকটাই কেটে যাবে বলে তারা মনে করেন। তারা এটাকে জরুরি মনে করলেও ছাত্রনেতারা সতর্ক করে বলেছেন, তরুণ নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করার পথ প্রশস্ত করা এবং ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ঠিক না করে নির্বাচনে গেলে দেশ পুনর্গঠন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। গতকাল শুক্রবার আমাদের সময়কে দেওয়া বক্তব্য এবং সাম্প্রতিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে নেতাদের এ ভাষ্য উঠে এসেছে।এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনী সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুদার মনে করেন, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতেই রোডম্যাপ তৈরি হওয়া উচিত। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমরা যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো করব, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে অন্তর্বর্তী সরকার। সংলাপ বা আলোচনায় তারা কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছবেন। এ প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি হবে। তিনি বলেন, সংস্কার করতে কত সময় লাগবে এবং সেই সংস্কার সরকার ও নির্বাচন কমিশন কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, তা বিবেচনা করেই নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি হওয়া যৌক্তিক।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, পতিত সরকার আজকে বিদেশে গিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। এ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা দেশের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। অতি দ্রুত সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দেওয়া হলে জনগণ নির্বাচনমুখী হবে। এরপরে কেউ এ ষড়যন্ত্র করতে সাহস পাবে না।রাষ্ট্র সংস্কার কাজে গণমানুষের কল্যাণকে বড় করে দেখছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বমুখী বাজারে সাধারণ মানুষ যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন গত চার মাসে কেন ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙা গেল না? ৫ আগস্টের পরও পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন ঠিক হয়নি। জুলাই আন্দোলনে যারা দেখে দেখে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করল, সেই পুলিশ সদস্যরা এখনও বহালতবিয়তে রয়েছেন। ভালো একটি নির্বাচনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন ভালো একটি পুলিশ বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। আমরা বলছি না এখনই নির্বাচন দিতে হবে। তবে সংস্কার হোক গণমানুষের কল্যাণের জন্য।বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স গতকাল এক অনুষ্ঠানে সরকারের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচনব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে আমরা সব প্রত্যাশা করি না। এটি বিপ্লবী সরকার নয়; আবার নির্বাচিত সরকারও নয়। সুতরাং সব নয়, অল্প কিছু কাজ এ সরকারকে করে যেতে হবে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে। এ জন্য হঠাৎ নির্বাচন নয়। নির্বাচনব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে হবে। এরপর নির্বাচন দিন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, যে কোনো সংকট মোকাবিলায় দেশের মানুষ বর্তমানে একত্রিত হয়ে যায়। এর একটি উদাহরণ ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় সবাইকে একসঙ্গে দেখেছি। আমরা মনে করি, অভ্যুত্থানের এ শক্তিটা একত্রিত থাকলে বাংলাদেশের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াটি সহজ হবে। নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বলেছি গণপরিষদ নির্বাচন চাই। গণপরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার হবে। অর্থাৎ আগে গণপরিষদ, এরপর নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচনে তরুণ শক্তির একটি বড় অংশ ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তারা যেন প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এটার একটা প্রক্রিয়া থাকা উচিত। এই সুযোগটি দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো যেন তরুণ নেতৃত্ব সামনে নিয়ে আসে।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, জাতীয় ঐক্যের জন্য সবার সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ থাকতে হবে। যে কোনো সময় যে কোনো সংকট মোকাবিলার জন্য জাতীয় ঐক্য খুবই প্রয়োজন। এটা আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অনুভব করেছি। জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে উমামা বলেন, আমরা সংস্কারের আগে নির্বাচনের কথা বলছি না। বর্তমান ব্যবস্থায় সংস্কার না করে নির্বাচনের দিকে হাঁটলে দেশ আবার আগের অবস্থা অর্থাৎ ভোটে কারচুপি হবে। সেই জায়গাগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কারের আগে নির্বাচনের আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু বাকের মজুমদার বলেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হলে বিচ্ছিন্নতা দূর করে দেশের স্বার্থে সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। সেটি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য মনে করছি। দেখা গেছে, ভারত ইস্যু ও বন্যা ইস্যুতে সারাদেশের মানুষ জাতীয় ঐক্য দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা মনে করি, আগামীর বাংলাদেশে যে কোনো সংকটকালে সবার একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সেটা বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।নির্বাচনের বিষয়ে আবু বাকের বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল। সেখানে আমাদের এক দফার দুটি অঙ্গীকার ছিল। সেগুলো হলো ফ্যাসিবাদের সম্পূর্ণ বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এই দুটি বিষয় যদি সমাধান হয়ে যায়, তাহলে পরবর্তী সময়ে নির্বাচন হলে সেটি সুষ্ঠু হবে এবং বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা করবে। অন্যথায় নির্বাচন হয়ে গেলে বাংলাদেশকে নতুনভাবে পুনর্গঠন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন স্বাভাবিক হচ্ছে।