মূল্যস্ফীতি কমিয়ে প্রাইজ লেবেল বা পণ্যের দাম সহনশীল করতে দু-তিন বছর লাগবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মুনসুর। তিনি বলেন, বর্তমানে ফরেন এক্সচেঞ্জের কোনো সংকট নেই। যে কেউ এলসি খুলতে পারবে। বাজারে টাকা পাবেন না, কিন্তু ডলার পাবেন। এখানে একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে।বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মূল্যস্ফীতি ও পণ্যের দাম নিয়ে সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।গভর্নর বলেন, আমাদের আজকের সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল, রমজানের আগে কিছু নিত্যপণ্যের মূল্য ধরে রাখতে হবে আর কিছু নির্বাচিত পণ্যের ক্ষেত্রে দাম মনিটরিং করতে হবে। এসব বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। স্পর্শকাতর বিষয় হলো চালের দাম। আমরা দেখছি বর্তমানে চালের দাম গত বছরের তুলনায় ৫-৬ টাকা কম আছে।এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে যে দাম সেটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। আবার চালের ওপর ডিউটি শূন্য করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কেউ আমদানি করছে না। কারণ, ভারত থেকে চাল আমদানি করলে দেশে খরচ বেশি পড়ে। এজন্য আমদানি হচ্ছে না। তার মানে দেশের বাজারে চালের সরবরাহ খারাপ নয়, সেটাই বুঝায়। ফলে আমাদের ধারণা এ বছর চাল আমদানি করতে হবে না।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই চালের দাম কমুক, কিন্তু কৃষকের কথা ভাবতে হবে। কারণ, তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাই বলা যায়, চালের দাম ভবিষ্যতে যে খুব বেশি কমবে সেটা কিন্তু আশা করা ঠিক নয়।আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত মাসে (অক্টোবরে) দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পৃথিবীর সব দেশেই মুদ্রানীতি ঘোষণার পর ২ শতাংশ নেমে আসছে। কিন্তু সেটা ডাবল ডিজিট। শুধু যে কমেছে তা নয়, কোনো কোনো মাসে বেড়েছেও। আমাদের এখানে দুটি জিনিসের প্রতিফলন দেখা যায়, গত মাসে দেশে যে বন্যার হয়েছে সে কারণে সবকিছুর দাম বেড়েছে। আর দ্বিতীয়ত, দেশে যে আন্দোলন হলো তার একটা প্রভাব পড়েছে।তবে এটা (মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি) খারাপ কিছু না। এই বৃদ্ধিটা হয়তো সাময়িক। জুলাই মাসের পর থেকে মূল্যস্ফীতি কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয় না। আগে যেটা করা হতো। এজন্য মূল্যস্ফীতি কয়েক মাস হাইয়েস্ট থাকবে। এখন কিছু করার নেই। তবে বর্তমান ইনডেক্স সঠিক।তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়েনি। খুবই কম আছে, দু-তিন শতাংশের মধ্যেই আছে। এনার্জির দাম নেগেটিভ ১৭ শতাংশে আছে। জ্বালানি তেল, এলএনজির দাম কম আছে। এগুলো আমাদের সহায়তা করবে। এর সঙ্গে আমাদের এক্সচেঞ্জ রেটের ওপরে যদি কোনো প্রভাবে না পড়ে তাহলে আমদানি পণ্যে দাম কমতে বাধ্য।আমাদের করণীয় হলো অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। সেজন্য আমরা বাজার মনিটরিংয়ে জোর দিয়েছি। আমাদের মূল্য বাজারভিত্তিক। তবে আমরা পলিসি রেট বাড়িয়েছি। এজন্য কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। একই সঙ্গে ট্রেজারি রেটও বাড়েনি।
তিনি আরও বলেন, পলিসি রেট বাড়ানোর ফলে ব্যাংকের জন্য ট্রেজারিতে যে লাভটা করতো, যেমন ধরনের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সাড়ে ১২ টাকায় ট্রেজারি বিল কিনতো তারা। এখন সেটা ৮ থেকে ১০ টাকা কম খরচ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। ফলে আমাদের যে লাভ হতো সেটা কমিয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে ব্যাংকের লিকুইটি টাইট করে ফেলছি। এর একটা প্রভাব আগামীতে বাজারে পড়বে।বাজার মনিটরিং নিয়ে কী করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, আমরা বাজার মনিটরিং করছি। কিন্তু অযৌক্তিক মনিটরিং করলে বাজারে পণ্যের সংকট তৈরি হবে। ওভার মনিটরিং করে লাভ নেই। অভিযান পরিচালনা করে লাভ নেই। আমরা সরবরাহ বাড়িয়ে বাজার স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছি৷ দাম অতিমাত্রায় কমিয়ে দেওয়া যাবে না। তবে সামনে শীতকাল, সবজির দাম কমে যাবে। মূল্যস্ফীতিও কমবে। কিন্তু দাম কি আমি একেবারে নামিয়ে আনতে পারবো?
তিনি বলেন, আমাদের কাছে মূল্যস্ফীতির থেকে প্রাইজ লেবেল গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর কোনো দেশ প্রাইজ লেবেল কমাতে পারে না। এটা কমানো উচিতও না। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমিয়ে প্রাইজ লেবেলকে সহনশীল করতে হবে। মানুষের যখন আয় বেড়ে যাবে তখন সবকিছু সহজ হয়ে যাবে। সেটা হতে দু-তিন বছর লাগবে। তবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো। যেন প্রতিযোগিতার মাধ্যেমে দাম নির্ধারণ করা যায়।তিনি আরও বলেন, এছাড়া সরকার রেশনিং বাড়াচ্ছে, ৫ কেজি চালের জায়গায় ১০ কেজি করা হচ্ছে। ওএমএস বাড়ানো হচ্ছে। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। হটকারিতার কোনো সুযোগ নেই। বাজার স্থিতিশীল হতে বাধ্য এবং হবে। তবে সময় লাগবে।গভর্নর আরও বলেন, আমাদের বর্তমানে ফরেন এক্সচেঞ্জের কোনো সংকট নেই। যে কেউ এলসি খুলতে পারবে। এখন যে কোনো ব্যাংকে যে কোনো দিন এলসি মার্জিন ছাড়াই এলসি খুলতে পারবে। বাজারে টাকা পাবেন না, কিন্তু ডলার পাবেন। এখানে একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে।ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাজারে পর্যাপ্ত চাহিদা আছে। আমদানি করে চাহিদা মেটান। আমাদের দিক ধেকে যেটুকু করার আমরা করবো। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সময় লাগবে। গত ৫-৭ বছর ধরে আস্তে আস্তে যেটা বাড়িয়েছে, সেটা কমাতে সময়তো একটু লাগবেই।