মুহাম্মদ সাদেকুজ্জামান শরীফ ঢাকা থেকে কাজ করতে গিয়েছিলেন রোমানিয়ায়। পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা, খানিকটা ডায়েরির আকারে, ধরা রয়েছে এই বইতে। দালাল ধরে বিদেশে গিয়েছেন, এমন বাঙালি শ্রমিকের আত্মকথন আগে চোখে পড়েনি। বিশ্বায়িত পুঁজি একুশ শতকে সাবেক দাসপ্রথার যে নয়া সংস্করণ খাড়া করেছে, তা ‘ভদ্র’ পরিসরের আলোচনায় তেমন আসে না। কিছু আভাস মেলে সংবাদ প্রতিবেদনে, সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে। সে সব বিবরণে শ্রমিকদের উপর দালাল, নিয়োগকারীর নিপীড়ন প্রাধান্য পায়। শরীফও লিখেছেন, পৌঁছনোর পরেই পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া, জঘন্য বাসস্থানে গাদাগাদি করে রাখা, কালো-চামড়াদের দীর্ঘতর কাজের সময়, প্রতিশ্রুত মজুরির ভগ্নাংশ দান, অসুস্থতায় বেতন কাটা, এমন নানা অন্যায়ের কথা। কিন্তু সরকার-শ্রমিক, বা মালিক-শ্রমিক, এমন মোটা দাগের বৈপরীত্যে আটকে নেই তাঁর দিনলিপি। ফুটে উঠেছে অসহায়তার নানা স্তর। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ না পড়লে এক সঙ্গে খাওয়া চলবে না, এক বাংলাদেশি রুমমেট এমন দাবি করতে প্রথম দিনই ঘরের বাসিন্দারা দু’ভাগ হয়ে যায়। “যে ধর্মান্ধদের থেকে মুক্তি চাইছিলাম সেই জিনিস এখন আমার রুমে।” টাইম জ়োনের জন্য সময়ের হেরফেরকেও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র বলে ভাবেন তাঁর বাঙালি সহকর্মীরা, এটাও কম পীড়া দেয়নি তাঁকে। পরিচিতির নির্মাণ আর একটি স্তর। ভারত-বাংলাদেশের মুসলিম মনে করেন, যে কোনও দেশে মুসলিম মুসলিমের পাশে দাঁড়াবে। বিদেশে গিয়ে বোঝেন, ধর্ম দিয়ে জাতি-পরিচয় তৈরি হয় না, এমনকি আরবি ভাষাও একতার ভিত্তি নয়। ইরাকি দাঁড়ায় ইরাকির পাশে, তুর্কি তুর্কির পাশে— দেশই একমাত্র পরিচয়। জাতি-ধর্মনির্বিশেষে পরিযায়ী শ্রমিক নিষ্পেষিত, কিন্তু সংহতির চেষ্টা নেই। বইটি এই সঙ্কটের কারণের ইঙ্গিত দেয়। বিপন্নতার আর একটি স্তর পরিকল্পনাহীনতা— “শ্রমিকদের কেন জানি গুছিয়ে উঠা হয়ে উঠে নাই।” যাঁরা ঋণ করে আসেন, দেশে প্রচুর টাকা পাঠিয়েও তাঁরা ঋণের জাল থেকে বেরোতে পারেন না। রোমানিয়ার মতো ইউরোপের দেশগুলিতে আসা সহজ, কিন্তু রোজগার কম। তাই অবৈধ উপায়ে (গেম মেরে) ইটালির মতো দেশে পালানোর চেষ্টা করেন কর্মীরা। ধরা পড়লে চূড়ান্ত বিপদ। আবার গন্তব্যে পৌঁছলেও প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হয়। মাসে সাতশো ইউরোতে ইটালির পিৎজ়ার দোকানে দৈনিক বারো ঘণ্টা কাজ করেন শরীফের বন্ধু। ভারত-বাংলাদেশ-নেপালের কর্মীদের জীবন এ ভাবে ক্ষয় হয়। অন্য দিকে, ঢাকায় ফিরে শরীফ দেখেছেন দালালদের রমরমা— “এই এজেন্টরা বছরে পিকনিক করে একবার, সভাপতি এক কোটি টাকা চাঁদা দেয়।” সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে এ বইকে বলা চলে ‘এথনোগ্রাফিক স্টাডি’— লেখক একাধারে শ্রমিক জীবনের অংশীদার ও পর্যবেক্ষক। শরীফ উচ্চশিক্ষিত, উদারবাদী। তিনি অস্কারের ভালমন্দ সম্পর্কে সমাজমাধ্যমে মতামত দেন, নারী অধিকার ও সংখ্যালঘুর অধিকারের উৎসাহী সমর্থক। এমন মানুষের কলমে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশে বাঙালি শ্রমিকের জীবনের নিবিড়পাঠ বিরল প্রাপ্তি। সাহিত্যের বিচারেও বইটি চমৎকার উতরেছে— সহজ কথ্যভাষা, সরস বাচনভঙ্গি, অপরিচিত জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি কৌতূহল, প্রবাসীর বিষাদের মধ্যেও নানা কৌতুকময় বিবরণ, এ সবই উত্তম লেখকের পরিচয়। অনেক বাঙালি পাঠক এই বই পড়ে রোমানিয়ার সঙ্গে প্রথম পরিচিত হবেন। আর পরিচয় হবে মুখহীন, নামহীন, কণ্ঠহীন কিছু লোকের সঙ্গে, যাঁরা আরও ভাল জীবনের আশায় বিদেশে বাস করেন, অথচ জীবন ফেলে এসেছেন দেশে।