ইরান ও ইসরায়েল দীর্ঘদিন একে অপরের ভূখণ্ডে প্রকাশ্যে সামরিক হামলার বিরুদ্ধে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা মেনে চলেছে। তবে গত কয়েক দিনে উভয় দেশই সে কথা ভুলে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে একটি বিপজ্জনক নতুন যুগে ঠেলে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো– প্রতিটি পক্ষ তাদের প্রতিরক্ষা শক্তি প্রদর্শন এবং মুখ বাঁচানোর বাধ্যবাধকতায় সন্তুষ্ট হয়েছে কিনা? নাকি তারা ক্রমবর্ধমান একটি নতুন চক্রে প্রবেশ করবে, যা সংকটকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।
ইসরায়েল শুক্রবার ভোরে ইরানের ইস্পাহান শহরের কাছে হামলা চালানোর পরই তাৎক্ষণিকভাবে বলটি এখন তেহরানের কোর্টে। খবর সিএনএনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত সপ্তাহান্তে ইরানের নজিরবিহীন ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পর ইসরায়েলের পাল্টা আঘাত খুবই নগণ্য ছিল। মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, হামলায় এ অঞ্চলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি।তবে অন্য সময়ের মতো সিরিয়া বা ইরাকে ইরানি ছায়াশক্তির পরিবর্তে ইসরায়েল এবার ইরানের অভ্যন্তরে হামলা করেছে। উভয় দেশের শক্তির এই প্রদর্শনে বিদ্যমান উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এই সংকীর্ণ পথে চলাচলের চেষ্টার ঝুঁকি হলো এ অঞ্চলটিতে ছয় মাস ধরে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। তা ছাড়া ইরান ও ইসরায়েলের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক উত্তেজনা এতটাই তীব্র যে, তাদের কার প্রতিক্রিয়া কতটা কঠিন হতে পারে, তা সঠিকভাবে কেউই মূল্যায়ন করতে সক্ষম নয়।
উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে ইরান সতর্ক করে দেয়, যে কোনো আক্রমণের কঠোর জবাব দেওয়া হবে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান সিএনএনকে বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ ‘তাৎক্ষণিক এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের’ হবে। তা সত্ত্বেও শুক্রবারের ইসরায়েলের প্রতীকী হামলার পর প্রাথমিক ইঙ্গিত ছিল, ইরান সংঘর্ষকে আরেক ধাপ না বাড়িয়ে এই বিশেষ পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটাতে প্রস্তুত। অন্যদিকে ইসরায়েলকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন ও পশ্চিমা মিত্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তাদের আশঙ্কা, উত্তেজনা বাড়লে তা বড় আঞ্চলিক যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও সরকারি কর্মকর্তারা শুক্রবারের হামলার ঘটনাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। এ হামলায় ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একটি আঞ্চলিক গোয়েন্দা সূত্র সিএনএনকে বলেছে, দুই বৈরী দেশের মধ্যে সরাসরি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের হামলা ‘শেষ’ হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি হয়তো ছিল না, কিন্তু দুটি দেশই বড় ধরনের প্রথাগত সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। এটা পুরো অঞ্চলকে গ্রাস করতে পারে এবং এতে বহু ইসরায়েলি, ইরানি ও প্রতিবেশী দেশের মানুষ নিহত হতে পারে। অবশ্য এবারের হামলা-পাল্টা হামলায় ইরান বা ইসরায়েলের কেউই অপমানজনক পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হয়নি। এটা হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি।
শীতল ভূরাজনৈতিক চিত্র
ইসরায়েল বড় ধরনের সামরিক শক্তি হলেও দেশটি গভীরভাবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। এটি এখন কার্যকরভাবে তিনটি ফ্রন্টে লড়াই করছে– গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে, লেবানন সীমান্তে ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে উত্তপ্ত সংঘাতে এবং সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে।
বিশেষ করে হিজবুল্লাহর হুমকি ভয়াবহ। কারণ, সশস্ত্র সংগঠনটির কাছে হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা ইসরায়েলি শহরগুলোতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। ইরানের সমর্থনে সংঘাতে হিজবুল্লাহর পূর্ণ মাত্রায় প্রবেশ ব্যাপক ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে। এতে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের আবাসস্থল লেবাননও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।
গত কয়েক দিনের ঘটনাবলির অর্থ হলো, এ অঞ্চলটি অবিলম্বে বড় আকারের যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে না। তবে আগে যেমনটা মনে করা হতো, ইরান কখনোই প্রকাশ্যে ইসরায়েল আক্রমণ করবে না এবং ইসরায়েলও একইভাবে ইরানের মাটিতে হামলা চালাবে না, আগের সেই অনুমান ভেস্তে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় প্রেসিডেন্টের আমলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আলোচনাকারী অ্যারন ডেভিড মিলার সিএনএনকে বলেন, ‘আপনি ইরানের কোনো প্রতিশোধ ছাড়াই এই ধাপটি অতিক্রম করলেও বাস্তবতা হলো ইসরায়েল ও ইরান এই প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ে আটকে যাবে। ইরানি ছায়াশক্তির সমস্যার কোনো সমাধান নেই। ইরান যে পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশ, এই সত্যেরও কোনো সমাধান নেই। এই সম্পর্কটি এই অঞ্চলে এবং সম্ভবত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর ডিমোক্লেসের তরবারির মতো ঝুলতে চলেছে।’
ভূরাজনীতির খেলায় মধ্যপ্রাচ্যে ইরান সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তদুপরি কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের নতুন বাস্তবতা ইরানকে তার নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে প্ররোচিত করতে পারে। মনে করা হচ্ছে, মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে পারে। সাম্প্রতিক দিনগুলোর ক্রমবর্ধমান বিপদ তাই কেবল সামনের দিনগুলোতে আস্বাদন করতে হতে পারে।