পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের ২১টি প্রকল্পে হরিলুটের প্রমাণ পেয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি। এসব প্রকল্পের কেনাকাটা থেকে শুরু করে অবকাঠামো নির্মাণে বেসুমার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। আর এই দুর্নীতির নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। প্রতিটি প্রকল্পের দুর্নীতির নকশা প্রণয়ন করতেন পলক। তার দিকনির্দেশনায় প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি, কনসালটেন্ট ও ঠিকাদার নির্ধারণ থেকে শুরু করে কেনাকাটা করা হতো। পকেট ভরতে এক কাজ বারবার করা হয়েছে। আবার একই প্রকল্প দুই মন্ত্রণালয়ে গ্রহণ করেও সরকারের অর্থ অপচয় করা হয়েছে বলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা-দপ্তরগুলোতে ২০০৯ সাল হতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেওয়া ২১টি প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি খুঁজতে এবং প্রকল্পগুলোর সার্বিক অবস্থা মূল্যায়ন করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি কমিটি গঠন করে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের নির্দেশে এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অনুবিভাগ) মাহবুবুর রহমানকে। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী সরাসরি এই তদন্তে দিকনির্দেশনা দেন। পরে এতে যুক্ত হন তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের পলিসি অ্যাডভাইজার ফায়েজ আহমদ তৈয়ব।
তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনে প্রকল্পগুলোতে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত যেসব অপচয়, অসঙ্গতি, দুর্বলতা, আর্থিক ক্ষতি, অসম চুক্তি, সুবিধাভোগী নির্বাচনে অস্বচ্ছতা, জনবল নিয়োগে অনিয়ম, অনৈতিকতা, একই কাজ বারবার করার মতো বিভিন্ন দিক চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকল্পগুলোর অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং দুর্নীতি ঠেকানো গেলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এই ২১টি প্রকল্পে এখনও প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের সুযোগ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য তদন্ত কমিটি পাঁচ দফা সুপারিশ করেছে।ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয় পতিত সরকারের আমলে। এই খাতের অনিয়মের বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। ডিজিটালের নানা সুবিধার স্বপ্ন দেখিয়ে প্রায় প্রতিটি প্রকল্পেই দুর্নীতির মচ্ছব শুরু করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ মুখ খোলার সাহস পায়নি।ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে একটি ভয়াবহ লুটপাট ও অপব্যবস্থাপনার খাত হিসেবে পরিচিত করিয়ে দিয়ে গেছে। আওয়ামী অপকর্মে দেশের ডিজিটাল ইকোনমি এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতিও নাজুক হয়েছে।
তিনি বলেন, এমন বেপরোয়া দুর্নীতির ওপর দাঁড়িয়ে গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী নতুন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্তির পরে এই খাতের অপখরচ ও মেগা দুর্নীতি থামানোর জন্য যথাযথ তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছি। আমি তদন্তদলকে ধন্যবাদ জানাই। তবে এমন তদন্ত যাতে অতীতের মতো ফাইলবন্দি হয়ে না থাকে। বরং আগামী ১০০ দিনের কার্যক্রমে সুপারিশগুলো অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা দিয়েছি। আগামীতে যাতে আওয়ামী লীগের অপখরচের এই মডেল কন্টিনিউ না করে তার নির্দেশনা দিয়েছি।তথ্যপ্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে আমরা এই খাতে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতের চিহ্নিত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।তিনি বলেন, এর মধ্যে এই খাতে নেওয়া প্রকল্পগুলোতেও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খোঁজ মিলেছে। ডুপ্লিকেশন, ট্রিপলিকেশন হয়েছে। একটা কাজ হয়তো হয়ে গেছে আবার একই কাজ করা হয়েছে। ৫ টাকায় যে কাজ করা যেত সেটি ওই প্রকল্পেই ২০ টাকায় করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও কাজই হয়নি। আমরা রাষ্ট্রের অর্থ ও সম্পদ রক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো কেটে দিচ্ছি। এগুলো হতে কীভাবে দেশ ও জনগণের সর্বোচ্চ লাভ হয় তা দেখছি উল্লেখ করেন তিনি। যেসব প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি :
মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন (৩য় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্প, দীক্ষা-দক্ষতা উন্নয়নে শিক্ষা অনলাইনে (১ম সংশোধিত), এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম, আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (১১টি) (১ম সংশোধিত প্রকল্প, আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন (১৪টি) প্রকল্প, হাই-টেক সিটি-২ এর সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প, জেলা পর্যায়ে আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপন প্রকল্প (১২টি জেলায়) (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকোসিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ফ্রনটিয়ার টেকনোলজি, শিবচর মাদারীপুরে প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, এস্টাবলিস্টমেন্ট অব বাংলাদেশ-ভারত সার্ভিস অ্যান্ড অ্যামপ্লয়মেন্ট ট্রেইনিং প্রকল্প, ডিজিটাল সরকার ও অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ (ইডিজিই) প্রকল্প, টেলিযোগাযোগ সুবিধা বঞ্চিত এলাকাসমূহে ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি স্থাপন (কানেক্টেড বাংলাদেশ) প্রকল্প, গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, বিজিডি-ই-গভ সার্ট এর সক্ষমতা বৃদ্ধি (১ম সংশোধিত প্রকল্প), সরকারের ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, ডিজিটাল সিলেট সিটি, ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প (২য় পর্যায়) ও হার পাওয়ার প্রকল্প প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্প (১ম সংশোধিত)।